এ কে এম জাকারিয়া:‘যে সময় আমরা পার করে এসেছি, ইতিহাসের সেই অধ্যায়গুলো আমরা নতুন করে লিখতে পারব না। কিন্তু ইতিহাস থেকে আমরা শিখতে, গ্রহণ করতে এবং সে অনুযায়ী নিজেদের বদলাতে পারি। নতুন স্বাভাবিক একটি তুলনামূলক ভালো স্বাভাবিক হতে পারে এবং নিশ্চিতভাবেই তা হবে একটি ভিন্ন স্বাভাবিক।’
ওপরের কথাগুলো যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ম্যাকেঞ্জির ব্যবস্থাপনা অংশীদার আয়ান ডেভিসের। অনেকেরই মনে হতে পারে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্ব যে নতুন পরিস্থিতির মুখে পড়েছে, তা বিবেচনায় নিয়েই তিনি এ মন্তব্য করেছেন। কারণ, ‘নতুন স্বাভাবিক’ বা ‘নিউ নরমাল’ শব্দবন্ধটি আমাদের অনেকের কাছে একেবারেই নতুন, এ মহামারিকালে শোনা। কিন্তু ডেভিসের এ মন্তব্য ১১ বছর আগের। ‘দ্য নিউ নরমাল’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ তিনি লিখেছিলেন ২০০৯ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাকালে।
আসলে মহামারি বা অর্থনৈতিক মন্দা যেটাই হোক, এসব পরিস্থিতি সামনের দিনগুলো নিয়ে আমাদের উদ্বেগের মুখে ফেলে। নতুন পরিস্থিতি কী হবে বা হতে পারে, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা ঘিরে ধরে। চলমান বর্তমানকে বিবেচনায় নিয়েই ভবিষ্যতের কথা ভাবা হয়। বর্তমানের খারাপ পরিস্থিতিকে ‘স্বাভাবিক’ মনে করা বা মেনে নেওয়াকেই কর্তব্য বলে ধরে নেওয়া হয়। ‘নতুন স্বাভাবিক’ বলতে যেসব পরিস্থিতি তুলে ধরা হচ্ছে তা কতটা ‘স্বাভাবিক’, সেই প্রশ্ন তুলে আগে একটি লেখা (‘নতুন স্বাভাবিক’ কতটা স্বাভাবিক, প্রথম আলো অনলাইন, ১৪ জুলাই ২০২০) লিখেছিলাম। আগ্রহী পাঠকেরা পড়ে দেখতে পারেন।
সময়ের সঙ্গে মানুষের আচার-আচরণ, জীবনযাপন, চিন্তাভাবনা বদলায়। এর সঙ্গে প্রযুক্তির উন্নতি ও অর্থনীতির সম্পর্ক রয়েছে। এ বদলের নির্দিষ্ট গতি আছে এবং এর জন্য প্রস্তুতি থাকে। কিন্তু কোনো বিশেষ ঘটনা বা পরিস্থিতি যখন আমাদের দীর্ঘদিনের অভ্যাস ও জীবনযাপনকে আকস্মিক ও প্রস্তুতিহীনভাবে খুব বদলে দেওয়ার পরিস্থিতি তৈরি করে, তখন তা ‘স্বাভাবিক’ হতে পারে না। কোভিড-১৯ জীবন ও অর্থনীতিকে যেখানে নিয়ে এসেছে, তাকে মেনে নেওয়া ছাড়া আপাতত আমাদের সামনে পথ নেই। কিন্তু এটাই নতুন স্বাভাবিক, এভাবেই আমাদের চলবে—এমন ধারণা বিচার-বিবেচনা ছাড়া মেনে নেওয়ারও সম্ভবত কারণ নেই।
আমরা এখন অহরহই শুনছি যে জীবন আর কখনো আগের মতো হবে না। এ নিয়ে অনেক তাত্ত্বিকের লেখা ও মতামত আমরা পড়ছি। এমন ধারণার বাস্তব ভিত্তি আছে। কারণ, কোভিড-১৯ বিশ্বকে এমন অভাবিত অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে, যা অনেক কিছুতেই বদল আনতে পারে। জীবনাচরণে কিছু বদল আসা যেমন অস্বাভাবিক নয়, তেমনি প্রতিটি দেশ ও বিশ্ব অর্থনীতির ওপর এর প্রভাব মানুষের জীবনযাপনকে সংকুচিত করতে বাধ্য করবে। কিন্তু এখনো আমরা মহামারিকালের মধ্যে রয়েছি। এ পরিস্থিতির মধ্যে থেকে ‘নতুন স্বাভাবিকের’ ধারণা কিসের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারণ করা হচ্ছে? এখন আমরা যে অস্বাভাবিক সময়ের মধ্যে রয়েছি, সেটাই কি ‘নতুন স্বাভাবিক’ নির্ধারণের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে?
টেকসই উন্নয়নবিষয়ক গবেষক চাইম এসোনি ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামে ‘দেয়ার ইজ নাথিং নিউ অ্যাবাউট দ্য নিউ নরমাল’ শিরোনামের এক লেখায় এ ধারণার সমালোচনা করে বলেছেন, ‘নিউ নরমাল’ ধারণা শুধু ‘বর্তমান’ পরিস্থিতিকেই সত্য বলে ধরে নিচ্ছে। কিন্তু এ মহামারির কোন বিষয়টিকে আসলে সুনির্দিষ্টভাবে ‘স্বাভাবিক’ বলা যাবে? সমাজকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলা কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। কোভিড-১৯ পরিস্থিতি আমাদের মধ্যে যে হারানোর দুঃখ ও হতাশার অনুভূতি তৈরি করেছে, নতুন স্বাভাবিকের ধারণা তাতে অভ্যস্ত হতে বলছে। চাইমের মতে এ বিকৃত বাস্তবতাকেই নিউ নরমালের স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে ধরে নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলছেন, একটি ডিসকোর্স হিসেবে ‘নতুন স্বাভাবিক’ নিয়ে আলোচনা হতে পারে, কিন্তু বর্তমান সংকটকে এ লেন্স দিয়ে বিশ্লেষণ করা যাবে না। এ ধারণা প্রথমত ব্যক্তির মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এবং সমাজের অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রে ‘স্বাভাবিক’ বিষয়টি যে আদৌ কাজ করে না, নতুন স্বাভাবিকের ধারণা সেই সত্যকে স্বীকার করে না।
নতুন স্বাভাবিক নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা ও তর্কবিতর্ক চলছে এবং সামনেও চলবে। কিন্তু এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের ভাবনা কী? ফেসবুকে বন্ধুদের উদ্দশে একটি প্রশ্ন রেখেছিলাম; কোভিড-১৯ আপনার জীবনে কী বদল আনল? ‘নিউ নরমাল’ বা ‘নতুন স্বাভাবিক’ হিসেবে কিছু আপনার জীবনে কিছু যুক্ত হয়েছে কি? হয়ে থাকলে সেটা কী?
অনিশ্চিত পরিস্থিতি কোনো সিদ্ধান্তে আসা বা সমাধানের পথ খোঁজার জন্য ঠিক সময় হতে পারে না। অথচ নতুন স্বাভাবিকের ধারণা এখনই একটি পথ খুঁজে নিতে চাপ দিচ্ছে। চাইম মনে করেন, এ অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে উল্টো এটা স্বীকার করা ভালো যে এখন যা ঘটছে তা স্বাভাবিক নয়। আমাদের দুঃখবোধ বা আমরা যে ভয় পাচ্ছি তা ঠিক আছে। এখন যা ঘটছে তার মধ্যে স্বস্তি খোঁজা ঠিক নয়। বরং আমাদের সবার উচিত বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে অস্বস্তিতে থাকা, কারণ ‘নতুন স্বাভাবিক’ এমন একটি বাস্তবতার কথা বলে, যেখানে অনেকেরই ঠাঁই হবে না।
নতুন স্বাভাবিক নিয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা ও তর্কবিতর্ক চলছে এবং সামনেও চলবে। কিন্তু এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের ভাবনা কী? ফেসবুকে বন্ধুদের উদ্দশে একটি প্রশ্ন রেখেছিলাম; কোভিড-১৯ আপনার জীবনে কী বদল আনল? ‘নিউ নরমাল’ বা ‘নতুন স্বাভাবিক’ হিসেবে কিছু আপনার জীবনে কিছু যুক্ত হয়েছে কি? হয়ে থাকলে সেটা কী?
মোট ৫৯ জন এতে সাড়া দিয়েছেন। নতুন স্বাভাবিক হিসেবে কারও জীবনে সুনির্দিষ্টভাবে কিছু যুক্ত হয়েছে এমন জবাব খুবই কম। যা পেয়েছি সেগুলো অনেকটা এ রকম; অনলাইনে কেনাকাটা করা, মাস্ক পরা, হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহার, হাত ধোয়া, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বা স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন, হোম অফিস, চাকরি চলে যাওয়া বা অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া ইত্যাদি।
এর বাইরে সবাই এ সময়ে নিজের অভিজ্ঞতা, জীবন সম্পর্কে বোধোদয় বা কিসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, সেই প্রসঙ্গে লিখেছেন। সাধারণভাবে তাঁরা যা বলেছেন সেগুলো হচ্ছে বাসার কাজে অভ্যস্ত হয়েছেন, পরিবারকে সময় দিতে পেরেছেন, নতুন কাজ শিখেছেন, অপচয় কমেছে, সঞ্চয়ের গুরুত্ব বুঝেছেন, সংযমী হওয়ার শিক্ষা পেয়েছেন, পরিপক্ব হয়েছেন ইত্যাদি।
বোঝা যাচ্ছে, এই যে এত নিউ নরমাল নিউ নরমাল শুনছি, এর প্রভাব আসলে আমাদের জীবনে খুবই সামান্য। মাস্কের ব্যবহার, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে সচেতন হওয়া, অনলাইনে কেনাকাটায় অভ্যস্ত হওয়া বা হোম অফিস ছাড়া এ তালিকায় আর কিছু যুক্ত করা যায় কি? সবচেয়ে বড় কথা, এ বিষয়গুলো দেশের শহুরে, শিক্ষিত ও সচেতন মানুষের বিষয়। দেশের অধিকাংশ মানুষের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই। আর মহামারির মতো একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে মানুষ যা করেছে, তার কতটা সামনে টিকে থাকবে, সেটাও এক বড় প্রশ্ন।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অফিস-আদালত সব খুলে গেছে। ‘হোম অফিসের’ ধারণা সামনে কোনো প্রতিষ্ঠান ধরে রাখার চেষ্টা করবে কি? নেটফ্লিক্সের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা রিড হেস্টিংসকে ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল–এর তরফে প্রশ্ন করা হয়েছিল, হোম অফিসের কোনো ইতিবাচক দিক তিনি দেখছেন কি না। তাঁর স্পষ্ট জবাব, ‘না, আমি কোনো ইতিবাচক দিক দেখছি না।’ তিনি মনে করেন, মানুষে মানুষে সরাসরি যুক্ত হতে না পারার বিষয়টি খুবই নেতিবাচক। তবে মহামারি কেটে গেলে তাঁর প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা সপ্তাহে এক দিন হোম অফিস করার সুযোগ পেতে পারেন—এমন ধারণা তিনি দিয়েছেন।
নতুন স্বাভাবিক হিসেবে হোম অফিসের ভবিষ্যৎও খুব ভালো বলে মনে হচ্ছে না। আসলে এ নতুন স্বাভাবিক ধারণার পুরোটাই কোভিড-১৯ মহামারি অর্থনীতির যে ক্ষতি করে যাচ্ছে, তা সামাল দেওয়ার সঙ্গে সম্পর্কিত। অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এ মন্দা দীর্ঘস্থায়ী হবে। ফলে বিশ্বজুড়ে কৃচ্ছ্রসাধন বা খরচ কমানোর আয়োজন চলবে। সামনে কীভাবে কম লোকবল নিয়ে প্রতিষ্ঠান চালানো যায়, সেই চেষ্টা হবে। ছোট ছোট ব্যবসা ও উদ্যোগ চাপ সামলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে এবং সামনে আরও যাবে। অর্থনীতির এ মন্দাবস্থার মূল চাপ পড়বে কর্মসংস্থানের ওপর। মানুষ কাজ হারাবে, আয়ের পথ খুবই কমে যাবে।
সেই মর্মান্তিক ও অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। ক্যালিফোর্নিয়ার চ্যাপম্যান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মাইকেল অ্যাশলির এক লেখায় (হোয়াট ইফ দ্য ওল্ড নরমাল বিকাম দ্য নিউ নরমাল) পড়লাম, বিশ্বের অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান নাকি জুম কল করে কর্মীদের ছাঁটাইয়ের কথা জানিয়ে দিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে সেটাও করা হচ্ছে না, শুধু টেক্সট মেসেজ পাঠিয়ে ছাঁটাইয়ের দুঃসংবাদ দেওয়া হচ্ছে কর্মীদের। এ ‘অস্বাভাবিক’ পরিস্থিতির পেছনে নিষ্ঠুর বাস্তবতা থাকতে পারে, কিন্তু এর নাম ‘নতুন স্বাভাবিক’ হয় কী করে!
করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে শুধু লাখ লাখ মানুষের প্রাণ নেওয়া নয়, বরং মানবসভ্যতার বড় ক্ষতি করে গেল। নতুন স্বাভাবিকের নামে অস্বাভাবিক জীবনযাপনকেই সামনের দিনগুলোতে স্বাভাবিক হিসেবে চালানোর চেষ্টা চলবে।
● এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক
Leave a Reply