বরগুনা প্রতিনিধি ॥ বরগুনায় আলোচিত কিশোর সন্ত্রাসী ও রিফাত হত্যা মামলার প্রধান আসামি সাব্বির আহমেদ ওরফে নয়ন বন্ড ‘বন্ধুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। ফেসবুক ভিত্তিক ম্যাসেঞ্জার গ্রুপ ‘বন্ড ০০৭’র নানা অপতৎপরতা সামনে আসলে বেড়িয়ে কিশোর গ্যাং গ্রুপের ভীতিকর তথ্য-উপাত্ত্ব। এনিয়ে ব্যাপক তোলপাড় শুরু হলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নড়েচড়ে বসে। এর পরে কিছুদিন এ গ্রুপটির কার্যক্রম স্থগিত থাকলেও এখন ‘টিম ৬১‘ গ্রুপে সংঘবদ্ধ হতে শুরু করে। জানা যায়- আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এই গ্রুপটিও বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
তবে স্থানীয়রা বলছেন, বরগুনায় এখনও ৩/৪ কিশোর গ্যাং সক্রিয় রয়েছে। তাদের নানা অপরাধের কারণে আতঙ্কে থাকেন এলাকার লোকজন। মাঝেমধ্যে এই কিশোরদের বাইকে চেপে শহরে চক্কর দিতে দেখা যায়। ২০১৯ সালের ২৬ জুন খুন হন বরগুনা শহরের তরুণ রিফাত শরীফ। এ হত্যা মামলায় গত ৩০ সেপ্টেম্বর প্রাপ্তবয়স্ক আসামিদের বিরুদ্ধে রায় হয়।
রিফাতের স্ত্রী আয়েশা সিদ্দিকা মিন্নি ও রিফাত ফরাজীসহ ৬ আসামির মৃত্যুদ- দেন আদালত। খালাস পান অপর চারজন। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ কিশোরের বিচার চলছে বরগুনার শিশু আদালতে। রায়ের পর বরগুনার কিশোর গ্যাংয়ের নানা অপকর্ম ও মাদক সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি আবার আলোচনায় আসে। এ বিষয়ে নাগরিক অধিকার সুরক্ষা কমিটি, বরগুনার সাধারণ সম্পাদক মনির হোসেন কামাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘রিফাত হত্যা মামলার আশানুরূপ রায় পেয়েছি আমরা। কিন্ত হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে যে কিশোর অপরাধ ও মাদক, এর কোনোটাই কমেনি।’ ‘কিশোর গ্যাং যে অনিয়ন্ত্রিত এর প্রমাণ ঈদুল ফিতরের দিন বিকেলে চরকলোনি এলাকার হৃদয় নামের এক স্কুলছাত্রকে গুলবুনিয়া এলাকায় পায়রা নদীর তীরে পিটিয়ে হত্যা। কিছুদিন এই গ্যাং কালচার ও মাদক স্থিমিত ছিল। এখন আবার এর বিস্তার ঘটছে।’ কামাল মনে করেন, অভিভাবকদের অসচতেনতা ও উদাসীনতা, হাত বাড়ালেই মাদক ও সংস্কৃতি চর্চার পর্যাপ্ত সুযোগ না থাকায় এ অবস্থা অব্যাহত আছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের একার পক্ষে কিশোর গ্যাং ও মাদক দমন সম্ভব নয়। সম্মিলিত সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা ছাড়া বিকল্প নেই বলেও মন্তব্য করেন কামাল। গত বছরের ৮ অক্টোবর মাদ্রাসাপড়ুয়া বোনকে উত্ত্যক্তের প্রতিবাদ করায় শহরের মাছবাজার সেতুর ওপরে হিরু নামের এক মাদক ব্যবসায়ী প্রকাশ্যে ওই ছাত্রীর ভাই মিঠুকে (২১) রামদা দিয়ে কুপিয়ে জখম করে বলে অভিযোগ ওঠে। স্থানীয়দের ভাষায়, হিরু লাকুরতলা এলাকার মোকসেদ চৌকিদারের ছেলে। এলাকায় তার নেতৃত্বে একটি কিশোর-তরুণ গ্যাং রয়েছে। এর ঠিক একদিন আগে লাকুরতলা এলাকায় পূজার অনুষ্ঠানে যাওয়ার পথে নৃত্যশীল্পিদের উত্ত্যক্ত করে হিরু বাহিনীর কয়েকজন। এর প্রতিবাদ করায় নাচের প্রশিক্ষক আসাদকে মারধর করে তারা। এ ঘটনায় তিনি বরগুনা থানায় লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। কিন্তু হিরু ও তার বাহিনীর কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। ২৫ মে বিকেলে বরগুনা সদর উপজেলার গোলবুনিয়া পর্যটন এলাকায় পায়রা নদীর তীরে ঘুরতে গিয়ে কিশোরদের পিটুনিতে নিহত হয় হৃদয় নামের আরেক কিশোর। হৃদয় পৌর শহরের চরকলোনী চাঁদশী সড়কের বাসিন্দা দেলোয়ার হোসেনের ছেলে। বরগুনা টেক্সটাইল ও ভোকেশনাল স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ত সে। পরে জানা যায়, হৃদয় নিজেও চরকলোনি এলাকার একটি কিশোর গ্যাংয়ের সক্রিয় সদস্য ছিল। ঘুরতে গিয়ে ওই এলাকার কিশোরদের সঙ্গে বিবাদে জড়িয়ে প্রথমে হৃদয় তার বাহিনীকে খবর দিয়ে স্থানীয়দের ওপর হামলা করে। পরে স্থানীয়দের পাল্টা হামলার শিকার হয়ে নিহত হয় সে।
গত ৬ সেপ্টেম্বর পশ্চিম বরগুনার দুলালের কাছে পাওনা টাকা চাইতে গিয়ে বচসা হয় আইনজীবীর সহকারী জাকিরের। ক্রোক পুলিশ ফাঁড়ির সামনে আচমকা জাকিরের ওপর হামলা করে দুলালের ছেলে শুভ। উপর্যুপরি লাঠির আঘাতে জাকিরের মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে জখম হয়। দুলালের ১০ম শ্রেণি পড়ুয়া এই ছেলের সঙ্গে রিফাত হত্যায় জড়িত কিশোরদের কয়েকজনের সখ্য ছিল বলে অভিযোগ রয়েছে। এদিকে সম্প্রতি বরগুনার পাথরঘাটায় কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকর্মীর অস্ত্র হাতে তোলা সেলফি ফেসবুকে পোস্টের ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। এমডি রিমন সরদার নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ছবিগুলো আপলোড করা হয়। অ্যাকাউন্টটি সদর ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক রিমন সরদারের বলে নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা। কিশোর অপরাধীদের নেপথ্যে ক্ষমতার উৎস হিসেবে রয়েছেন কিছু মাদক ব্যবসায়ী। রাজনৈতিক লেজুরবৃত্তি করা এসব মাদক ব্যবসায়ী কিশোরদের মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে ফেলছে। শহর থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে বিস্তৃতি ঘটেছে ইয়াবার। ইয়াবার সরবরাহকারী হিসেবে কাজ করছে কিশোরদের একাংশ-এমনটাই মনে করছেন ‘আমরা মুক্তিযোদ্ধার সন্তান’ সংগঠনের আহ্বায়ক ও সচেতন নাগরিকদের একজন মারুফ মৃধা। তিনি বলেন, “রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি করে বেড়ানো কথিত ‘বড় ভাই’ এই কিশোরদের সংগঠক ও পৃষ্ঠপোষক।কিশোরদের মাদক সেবন করিয়ে একপর্যায়ে তাদের ব্যবহার করে মাদক ছড়িয়ে দেয়া হয়। বরগুনার প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতেও এভাবে ছাত্র ও যুব রাজনীতির নামে লেজুড়বৃত্তি করে মাদক ব্যবসা ছড়িয়েছে।” ১ সেপ্টেম্বর সদরের নলটোনা ইউনিয়ন যুবলীগের সভাপতি আবু সালেহকে ইয়াবাসহ আটক করে পুলিশ। এ ঘটনায় সদর থানায় তার বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়। পরে দল থেকে বহিষ্কৃত হন তিনি। এর ঠিক দুই মাস আগে একই সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক ইমরান সিকদারকেও ইয়াবাসহ আটক করে পুলিশ। ৮ সেপ্টেম্বর একই ইউনিয়নের গোড়াপদ্মা গ্রাম থেকে ৫ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি মিরাজ ও তার সহযোগী কাশেমকে গাঁজাসহ আটক করে বাবুগঞ্জ তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ। বরগুনা জেলা পুলিশের হিসাব থেকে জানা গেছে, ২০১৪ সালে জেলায় মাদকের মামলা হয়েছে ১২৯টি। পরের বছর ২৭২টি। ২০১৬ সালে তা বেড়ে হয়েছে ৫৫৩টি। ২০১৭ সালে তা আরও বেড়ে হয়েছে ৭০৩টি। ২০১৮ সালে কিছুটা কমে হয়েছে ৬৯৪টি। ২০১৯ সালে তা আরও কমে হয় ৪৭৯টি। চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত মামলা ৭৯টি।
পুলিশ বলছে, গত বছরের জুনে রিফাত শরীফ হত্যার পর পুলিশের ব্যাপক তৎপরতায় মাদক ব্যবসা স্থিমিত হয়ে আসে। পুলিশ সুপার মারুফ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে। তবে বরগুনায় নাগরিকদের সংগঠন পাবলিক পলিসি ফোরামের আহ্বায়ক হাসান ঝন্টু মনে করেন, করোনাকালে মাদকবিরোধী অভিযানের দিকে পুলিশের মনোযোগ ছিল কম। এ কারণে মাদক কম উদ্ধার হয়েছে; মামলাও কম। কিশোর গ্যাং ও মাদক প্রসঙ্গে হাসান ঝন্টু বলেন, রাজনৈতিক পদ-পদবির বিপরিতে প্রভাব বিস্তার করে মাদকের ব্যবসায় জড়িয়েছে কতিপয় লোক। এরা মাদকের বিস্তৃতি ঘটানোর জন্য কিশোরদের ব্যবহার করে ও গ্যাং কালচার সৃষ্টি হয়। এখনই মাদকের বিস্তার রোধ না করা গেলে গ্যাং কালচার থেকেও বের হওয়া দুরুহ হয়ে পড়বে।’
Leave a Reply