আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী :
বাংলাদেশে নারী ধর্ষণের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডদানের বিধান ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গাজীপুরের শিমুলতলীতে একটি বর্বর নারী ধর্ষণের খবর ‘ঢাকা ট্রিবিউন’ অনলাইন পত্রিকায় পাঠ করলাম। ১৮ বছরের এক কলেজছাত্রীকে তার বন্ধু এক যুবক নইম দেখা করার নামে ডেকে নিয়ে আরও কয়েকজন বন্ধু মিলে ধর্ষণ করেছে।
এই ধর্ষণে বাধা দেয়ায় তরুণীর ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়ে একটি অটোরিকশা স্টেশনের কাছে তাকে ফেলে রাখা হয়। পথের লোক তাকে দেখতে পেয়ে হাসপাতালে নিয়ে যায়।
এই ধর্ষণ কাজটি যে উদ্দেশ্যে এবং যেভাবেই করা হয়ে থাকুক, আমার কাছে এটিকে সরকারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ মনে হয়। কেন মনে হয় সে কথায় পরে আসছি। গত শনিবারের ঢাকার অন্যান্য কাগজে আরও অনেক ধর্ষণের খবর আছে। সবগুলোর বয়ান এখানে দরকার নেই। একটি খবর হল, এক মাদ্রাসা শিক্ষক এক গরিব ছাত্রীকে কম খরচে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেবে এই প্রলোভন দেখিয়ে দু’মাস ধরে ধর্ষণ করে আসছিলেন।
পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। পুলিশ গ্রেফতার করেছে গাজীপুরের কলেজছাত্রীর ধর্ষকদের দু’জনকে। এই লেখার সময় পর্যন্ত প্রধান আসামি নইমকে পুলিশ ধরতে পারেনি। তবে দু’একদিনের মধ্যেই তাকে ধরতে পারবে আশা করছে।
খবরের কাগজে ধর্ষণের সংখ্যা দেখে মনে হচ্ছে, মৃত্যুদণ্ডাদেশ ধর্ষণের মতো অপরাধের প্রতিষেধক হলেও তা যে নারী ধর্ষণ একেবারে বন্ধ করতে পারবে না, গাজীপুরের গণধর্ষণ তার প্রমাণ। এটা সরকারের জন্য একটা রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ বলে কেউ কেউ মনে করেন। তারা এ সম্পর্কে আমার সঙ্গে আলোচনা করেছেন এবং তাদের সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশে সরকারবিরোধী কোনো রাজনৈতিক দল সরকারের বিরোধিতার জন্য হাতে কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না পেয়ে দেশে ধর্ষণের সংখ্যা বাড়াতে সাহায্য করে তাকে একটা রাজনৈতিক ইস্যু করার চেষ্টা চালাবার মতো নীচু মনোবৃত্তির পরিচয় দেবেন তা বিশ্বাসযোগ্য নয়। তবে সন্দেহবাতিকগ্রস্তদের কাছে সবই সম্ভব মনে হতে পারে।
এই সন্দেহবাতিকগ্রস্তদের একজন আমাকে আফ্রিকার ঘানার বহু অতীতের একটি গল্প শুনিয়েছেন। গল্পটি হল, ঘানাকে ঔপনিবেশিক দাসত্ব থেকে মুক্ত করে রাষ্ট্রপিতা ড. এনক্রুমা যখন দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন, তখন ঘানা একটি অত্যন্ত অনগ্রসর আফ্রিকান দেশ ছিল। অশিক্ষা, কুসংস্কার ছিল পরস্পর বিবদমান গোত্রগুলোর সমাজ জীবনের প্রতিস্তরে। নারী অপহরণ ও ধর্ষণ ছিল একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা।
রাজনৈতিক বিবাদ ছিল সর্বস্তরে। ড. এনক্রুমা কঠোর হাতে রাজনৈতিক সংস্কারে হাত দেন। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ কোনো রাজনৈতিক ইস্যু না পেয়ে নারী ধর্ষকদের উৎসাহ-প্রশ্রয় দিয়ে নারী নির্যাতনকে একটা বড় ইস্যু করে তোলেন। বহির্বিশ্বে তারা প্রচার করতে থাকেন এনুক্রুসা দেশে সামাজিক নিরাপত্তা- বিশেষ করে নারীদের নিরাপত্তাদানে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছেন। এনুক্রুসাবিরোধী এই প্রচারণায় সিআইএ ব্যাপকভাবে সাহায্য জুগিয়েছিল বলে জানা যায়।
এটা আমার কিছুটা শোনা গল্প, কিন্তু ব্যক্তিগত খবর জানা আছে ইসলামী বিপ্লবের পর ইরানে খোমিনীশাসন উচ্ছেদ করার জন্য নারী নির্যাতনের বানোয়াট কাহিনী বহির্বিশ্বে প্রচারের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোতে অসংখ্য নারীমুক্তি সমিতি গড়ে উঠে।
তারা ইরানে তাদের বর্ণিত মোল্লাশাসন কীভাবে নারীদের ওপর ধর্মীয় বিধানের নামে অত্যাচার চালাচ্ছে, তার মর্মন্তুদ কাহিনী পোস্টার, প্রচারপত্রে বিরাটভাবে ছেপে তা সাধারণ মানুষের মধ্যে বিলি করত। গোপনে ইরানেও তা বিলি করা হতো।
আমার সন্দেহ তো, আফগানিস্তানে বাদশা আমানুল্লার আধুনিক ও প্রগতিশীল শাসন উৎখাতের জন্য তখনকার ব্রিটিশ সরকার ইংরেজ ফকির লরেন্সের দ্বারা যে চক্রান্ত চালিয়েছিলেন, ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর এই নারী নির্যাতন বন্ধ করার আন্দোলন তদ্রুপ আন্দোলন। এর পেছনে সিআইএ’র ষড়যন্ত্র কাজ করেছে।
ধর্মীয় বিধানের নামে নারী নির্যাতন, নারীদের অধিকারবঞ্চিত করা সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে যতটা হয়, শিয়া অধ্যুষিত ইরানে ততটা হয় না। রেজা শাহের আমলে ইরানের নারীরা প্রায় পাশ্চাত্যের নারীদের মতো হয়ে উঠেছিলেন পোশাকে-আশাকে, অভ্যাস ও আচরণে। ইরানি মোল্লাদের মধ্যেও ধর্মীয় রক্ষণশীলতা কম। তেহরানের মসজিদে নবী ও খোমেনিদের ছবি আছে। তেহরানে পাবও গড়ে উঠেছিল অসংখ্য।
খোমেনিরা শাসন ক্ষমতায় আসার পর এই পাবে বন্ধ করা হয়েছে। নারীরা ঘরের বাইরে গেলে হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। দাড়ি রাখায় উৎসাহ দেয়া হয়েছে পুরুষদের। এছাড়া খেলাধুলায় অংশগ্রহণ, চাকরি-বাকরি, ব্যবসা-বাণিজ্যে যোগদান- কোনোটাতেই নারীর অধিকার ক্ষুণ্ন করা হয়নি। এই অধিকার ব্যাপকভাবে হরণ করা হয়েছে সৌদি আরব, ইয়েমেন, জর্ডান, আফগানিস্তান ইত্যাদি দেশগুলোতে।
এসব দেশে নারীমুক্তির জন্য আন্দোলন নেই, হঠাৎ ইরানের নারীমুক্তির জন্য লন্ডনে, প্যারিসে, নিউইয়র্কে এত বড় বড় আন্দোলন, তখনই আমার সন্দেহ হয়েছিল ‘ডাল মে কুছ কালা হায়’ অর্থাৎ সিআইএ’র লম্বা হাত এই তথাকথিত নারী আন্দোলনের পেছনেও প্রসারিত। আমার এই সন্দেহ সত্যে পরিণত হতে দেরি হয়নি।
বাংলাদেশের হাসিনা সরকারকে আমাদের সুশীল সমাজ পছন্দ করে না। কিন্তু আমি এই সরকারের সব ভুলত্রুটি সত্ত্বেও পছন্দ করি এবং সমর্থন করি। তার কারণ, অপরাধ দমনে এই সরকারের দক্ষতা এবং সাফল্য। বিএনপি, জামায়াত এবং তথাকথিত ‘জিহাদিস্টরা’ মিলে দেশে টানা তিন-চার বছর যে ভয়াবহ সন্ত্রাস চালিয়েছিল, অনেকেই মনে করেছিলেন এই সন্ত্রাস দমনে ব্যর্থ হয়ে সরকার পদত্যাগে বাধ্য হবে।
এই অনুমান সঠিক প্রমাণিত হয়নি। সরকার কঠোর হাতে এই রাজনৈতিক সন্ত্রাস দমন করেছে। নারী নির্যাতনের ক্ষেত্রে ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছিল নারীদের, বিশেষ করে স্কুল-কলেজে পড়ুয়া বালিকা ও তরুণীদের চোখে-মুখে-শরীরে এসিড নিক্ষেপ করা।
বিএনপি-জামায়াত আমলে এই এসিড-সন্ত্রাস চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলেও তারা এই অপরাধ দমনে মোটেও মনোযোগী হননি। চেষ্টাও করেননি। কোনো অপরাধী হঠাৎ ধরা পড়ে গেলে তাকে জেলে পাঠানোই ছিল তাদের একমাত্র তৎপরতা। এই ধূর্ত অপরাধীদের অধিকাংশই পরে নানা উপায়ে জেল থেকে বেরিয়ে এসে আবার নতুন করে অপরাধ ছড়ানোর কাজে লিপ্ত হয়েছে।
বিদেশে এসিড মারার অপরাধ একেবারে লুপ্ত হয়নি। বাংলাদেশেও হবে এমন আশা কেউ করেননি। ভারতে যে অপরাধ এখন পর্যন্ত দমন করা যায়নি, বাংলাদেশে তা করা যাবে তা কেউ স্বপ্নেও আশা করেননি। কিন্তু হাসিনা সরকারের তৎপরতায় দীর্ঘ এক যুগের এই ভয়াবহ এসিড-সন্ত্রাস এখন সম্পূর্ণ দূর হয়েছে। দু-একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া তরুণীদের মুখে দুর্বৃত্তদের এসিড মারার ঘটনা এখন আর শোনাই যায় না।
এখন প্রশ্ন, এই ভয়াবহ করোনাভাইরাসের বিস্তারের সময় যখন লন্ডন, প্যারিসের রাস্তায় প্রেমিক যুগলের দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া মাত্রই চুম্বন বিনিময়ের যে প্রথা ছিল, তা-ও যখন লুপ্ত হয়ে গেছে, পশ্চিমাদের এত প্রিয় শেক হ্যান্ড- তা-ও বন্ধ হয়ে গেছে, তখন বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলসহ রাজধানী ঢাকা এবং তার চারপাশে নারী ধর্ষণের ঘটনার এত অস্বাভাবিক স্ফীতি কেন? মানুষ যখন করোনার প্রকোপে মৃত্যু ভয়ে ভীত, তখন কি যৌন অপরাধে জড়িত হতে পারে?
এর স্বাভাবিক জবাব, মানুষ এমন যৌন অপরাধে লিপ্ত হতে পারে না। দীর্ঘ লকডাউনের ফলে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতে সংসারে ভাঙন, বিবাহ বিচ্ছেদের সংখ্যা বেড়েছে বটে, যৌন অপরাধ বাড়েনি। বাংলাদেশে একটু বেশি বেড়েছে। তাহলে এই যৌন অপরাধীদের কি কেউ পেছন থেকে কোনো উদ্দেশ্য সাধনে উৎসাহ জোগাচ্ছে? সেই উদ্দেশ্য কী, সন্দেহবাদীরা যা সন্দেহ করছেন, সেই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য?
বিএনপি-জামায়াতের রাজনৈতিক ইস্যুর তহবিল কি একেবারেই শূন্য হয়ে গেছে যে, তারা নারী ধর্ষক ও নির্যাতনকারীদের পেছন থেকে উৎসাহ জুগিয়ে নারী ধর্ষণকে সরকার উচ্ছেদের লক্ষ্যে একটি ইস্যু করতে চাইবে?
বিএনপির রাজনীতি এত তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে তা আমার বিশ্বাস হয় না। কিন্তু সন্দেহবাদীরা বলেন, বিএনপি যখন দেশের সর্বস্তরের সন্ত্রাসীদের উৎসাহ দিয়ে মাঠে নামিয়ে টানা তিন-চার বছর দেশের রাস্তাঘাটে জ্বালাও-পোড়াও, সন্ত্রাস চালিয়ে কয়েকশ’ নিরীহ নর-নারী-শিশু হত্যা করতে পেরেছে, গ্রেনেড হামলার মতো ভয়াবহ হামলা চালিয়ে নর-নারী-শিশু হতাহত করেছে, সেখানে এখন এসিড-সন্ত্রাসের পর তারা যৌন সন্ত্রাসীদের উৎসাহ জুগিয়ে থাকলে বিস্মিত হওয়ার কী আছে?
আমি এখনও এই সন্দেহবাদীদের দলে ভিড়তে রাজি নই এবং বিশ্বাস করতে চাই, দেশে বর্তমানে যে নারী ধর্ষণ ও নারী নির্যাতন বেড়েছে, তা অতীতের স্বৈরশাসনের আমল থেকে যে সামাজিক অবক্ষয় দ্রুত বাড়তে দেয়া হয়েছে, তার বর্তমান যোগফল। সরকার এই অপরাধের বিস্তার সম্পর্কে এখন সচেতন হয়েছে এবং এই অপরাধ দমনে সক্রিয় হয়েছে। নারী ধর্ষণে মৃত্যুদণ্ডদান তাদের একটি পদক্ষেপ মাত্র।
তারা আরও ব্যবস্থা নেবেন এবং তরুণীদের মুখে এসিড নিক্ষেপের সন্ত্রাসের মতো দেশ থেকে এই যৌন সন্ত্রাস দমনেও সফল হবেন, তা আশা করা যায়। বিএনপির নেতা মির্জা ফখরুল নারী নির্যাতন দমনে হাসিনা সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে বুলন্দ আওয়াজ তুলেছেন। তাদের আমলে নারী নির্যাতন কোন তুঙ্গে উঠেছিল এবং কত নারী আওয়ামী লীগের সমর্থক সন্দেহে নিষ্ঠুরভাবে ধর্ষিত হয়েছিল, তাদের নামের তালিকা সম্প্রতি মতিয়া চৌধুরী তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেছেন।
মতিয়া চৌধুরীর এ তালিকা সম্পর্কে মির্জা ফখরুল সাহেবরা কী বলতে চান, তা জানতে ইচ্ছে করে। আওয়ামী লীগের আমলেও নারী ধর্ষণ চলছে একথা সত্য; কিন্তু কোনো অসহায় মাকে বিএনপির ক্যাডারদের কাছে কাতর-অনুনয় জানাতে হয়নি, ‘বাবারা, আমার মেয়েটি নাবালক …।’
Leave a Reply