মনজুরুল হক:
জো বাইডেনের পরবর্তী প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়া নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের বরাবরের ঘনিষ্ঠ একাধিক মিত্রদেশের অঞ্চল পূর্ব এশিয়ায় কোন ধরনের পরিবর্তন মার্কিন অবস্থানে সূচিত হতে পারে, তা নিয়ে ইতিমধ্যে এ অঞ্চলের দেশগুলোতে আলোচনা শুরু হয়েছে। পূর্ব এশিয়া একই সঙ্গে হচ্ছে বিভিন্ন দিক থেকে অনিশ্চিত একটি অঞ্চল। উত্তর কোরিয়া এখানে পরমাণু অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা অব্যাহত রাখায় ট্রাম্পের সরে যাওয়া দেশটি কীভাবে দেখবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। অন্যদিকে নতুন সমরশক্তি হিসেবে চীনের উত্থানও এ অঞ্চলের সামনে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে। পাশাপাশি রাশিয়াকেও আংশিকভাবে আমরা পূর্ব এশিয়ার অন্তর্ভুক্ত দেশ হিসেবে ধরে নিলে সেখানেও দেখা যায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বেলায় উদ্বেগের শেষ নেই। জাপানের সঙ্গে দেশটির আছে চলমান ভূখণ্ডগত বিরোধ এবং ওয়াশিংটনের সঙ্গে নানা দিক থেকে মস্কোর চলছে টানাপোড়েন। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের অত্যন্ত কাছের দুই মিত্রদেশ জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও একধরনের দূরত্ব ট্রাম্প নিজেই তৈরি করে নিয়েছিলেন তার ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের কৌশল অবলম্বনের মধ্য দিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্প ও রিপাবলিকান প্রশাসনের বিদায় এখন তাই নতুন এক বাঁক নেওয়ার পথে ওয়াশিংটনকে নিয়ে আসছে, যা কিনা পূর্ব এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী ইয়োশিহিদে সুগা খুব বেশি বিলম্ব না করে বাইডেনকে অভিনন্দন জানানোয় ধারণা করা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিদ্যমান ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তিনি আরও বেশি পোক্ত করে নিতে আগ্রহী। পূর্বসূরি শিনজো আবের মতো ট্রাম্পের সঙ্গে অতিরিক্ত মাখামাখির সম্পর্ক তাঁর না থাকায় সেদিক থেকে অনেকটাই তিনি ভারমুক্ত। তবে কথা হচ্ছে ট্রাম্পের অনুসৃত নীতিমালা থেকে কতটা সরে আসতে বাইডেন আগ্রহী হবেন, তা এখনো পরিষ্কার নয়। ট্রাম্পের মতোই বাণিজ্য ভারসাম্য কমিয়ে আনার জন্য জাপানের ওপর চাপ দেওয়া অব্যাহত রাখার পাশাপাশি জাপানি ভূখণ্ডে মার্কিন সামরিক উপস্থিতির জন্য আরও বেশি অর্থ জাপানের কাছ থেকে আদায় করে নিতে তিনি চাইবেন কি না, সেটাও এখনো অনিশ্চিত রয়ে গেছে। এ ক্ষেত্রে ট্রাম্পের অবস্থান ছিল মার্কিন সামরিক উপস্থিতি তুলে নেওয়ার ভয় দেখিয়ে জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া উভয় দেশের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে নেওয়া। শীর্ষ পর্যায়ে দৃশ্যমান ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে চলা সত্ত্বেও যে অভিযোগ ট্রাম্প জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার বিরুদ্ধে করে আসছিলেন তা হলো দেশ দুটি হচ্ছে বিনা পয়সায় সুযোগ গ্রহণকারী এবং মার্কিন সামরিক নিশ্চয়তা পেতে হলে এদের উচিত হবে আরও বেশি অর্থ ঢালা।
বাইডেনের ডেমোক্রেটিক পার্টির সরকার সে রকম সরাসরি দুর্বৃত্তায়নের পথ যে পরিহার করবে, তা নিশ্চিত করে বলা গেলেও বাণিজ্য ভারসাম্য ও বিনিয়োগসংক্রান্ত বিষয়গুলোতে খুব বেশি ছাড় পাওয়ার প্রত্যাশা জাপান করছে না। আর এ কারণেই সুগা চাইছেন, যত দ্রুত সম্ভব বাইডেনের সঙ্গে টেলিফোন সংলাপ সেরে নিয়ে তুলনামূলক কম সময়ে ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। তবে এ জন্য তাঁকে বাইডেনের আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ পর্যন্ত অপেক্ষায় থাকতে হবে।
জাপানে ৫০ হাজারের বেশি মার্কিন সৈন্যের উপস্থিতি নিয়ে অতীতে দুই দেশের মধ্যে বড় ধরনের কোনো মতপার্থক্য দেখা দেয়নি, যদিও জাপানে নাগরিক পর্যায়ে সেই সামরিক উপস্থিতি নিয়ে অসন্তোষ বিরাজমান। সামরিক উপস্থিতির দোহাই দিয়ে মিত্রদের কাছ থেকে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে নেওয়ার বিষয়টি বাইডেন প্রশাসনের অনুসৃত নীতিতে প্রাধান্য না পেলেও যুক্তরাষ্ট্র সম্ভবত চাইবে জাপানের মতো পূর্ব এশিয়ার মিত্রদেশগুলো যেন অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখায় আরও বেশি বলিষ্ঠ ও সম্প্রসারিত ভূমিকা পালন করে। ওবামা প্রশাসনের সময়ও ঠিক এ রকম চাপের মুখে ছিল জাপান। সে রকম কিছু করতে হলে জাপানকে যে চীনের সমালোচনার মুখে পড়তে হবে, জাপানি নেতৃত্ব সে বিষয়ে ভালোভাবে অবগত। ফলে চীনকে জড়িত রেখে কিছু করা যায় কি না, সেই সম্ভাবনা খতিয়ে দেখছেন জাপানের নীতিনির্ধারকেরা।
অন্যদিকে দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে জাপানের চলমান বিবাদ নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানের কোনোরকম রদবদল হওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন না জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতারা। যুক্তরাষ্ট্র চাইছে বিতর্কের নিষ্পত্তি যেন জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া নিজেদের মধ্যে আলোচনার প্রক্রিয়ায় সেরে নেয়। অতি সম্প্রতি কিছুটা অগ্রগতি এ ক্ষেত্রে লক্ষ করা গেলেও অতীত ইতিহাসের ব্যাখ্যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যকার দূরত্ব এখনো আছে।
তবে পূর্ব এশিয়াজুড়ে সবচেয়ে বড় যে বাধা বাইডেন প্রশাসনকে মোকাবিলা করতে হবে তা হচ্ছে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক। অর্থনৈতিক দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্র এখন নানাভাবে চীনের ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে সামরিক শক্তির দিক থেকেও চীন এখন আগের মতো পিছিয়ে নেই। ফলে ভয় দেখিয়ে চীনকে বাগে আনার মতো পরিস্থিতি এখন আর নেই, যে চেষ্টা ট্রাম্প প্রশাসন করে যাচ্ছিল। আন্তপ্রশান্ত মহাসাগর অংশীদার বা টিপিপির মতো নতুন কোনো বহুপক্ষীয় কাঠামোতে চীনকে যুক্ত করে সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়া যায় কি না, জাপান সেটা এখন বিবেচনা করে দেখছে এবং ওয়াশিংটনকেও হয়তো টোকিও এ বিষয়ে প্রভাবিত করতে পারে। তবে তা করতে হলে তাইওয়ানসংক্রান্ত কঠোর অবস্থান থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে কিছুটা হলেও সরে আসতে হবে, যা কিনা যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শিল্প খাত দেখতে আগ্রহী হবে না। কেননা চীনা জুজুর ভয় দেখিয়ে বিশাল অঙ্কের যে সামরিক সরঞ্জাম তাইওয়ানের কাছে ট্রাম্প বিক্রি করতে শুরু করেছিলেন, মুনাফার সেই ভান্ডারে টান পড়ুক, সেটা তাদের কাম্য নয়।
(টোকিও, ৯ নভেম্বর ২০২০)
মনজুরুল হক: শিক্ষক ও সাংবাদিক
Leave a Reply