জাতীয় গ্রিড থেকে বিদ্যুৎ এনে কিংবা জেনারেটর চালু করে বাইরের অন্ধকার দূর করা যায়। কিন্তু মানুষের মনের অন্ধকার দূর করা কঠিন। জাতীয় সংসদের সদস্য হয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান রক্ষার শপথ নেওয়ার পরও যে মনের অন্ধকার দূর হয় না, তার প্রমাণ বগুড়া-৭ আসনের স্বতন্ত্র সাংসদ মো. রেজাউল করিম ওরফে বাবলু।
ধর্ষণের মহামারি বন্ধে গত মঙ্গলবার (১৭ নভেম্বর) জাতীয় সংসদে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ (সংশোধন) বিল, ২০২০ পাস হয়। এতে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ধর্ষণবিরোধী আন্দোলনের মুখে রাষ্ট্রপতি ১৩ অক্টোবর যে অধ্যাদেশ জারি করেছিলেন, এর মাধ্যমে তা আইনে পরিণত হলো। আইনে বলা হয়েছে, আক্রান্ত নারীকে ‘ধর্ষিতা’ না বলে ‘ধর্ষণের শিকার’ বলতে হবে।
বিল পাসের আগে আইনের পক্ষে–বিপক্ষে অনেক সাংসদ কথা বলেছেন। বেশির ভাগ সাংসদ আইনটি সমর্থন করেছেন। আবার কেউ কেউ আইনটির বিরোধিতা করে বলেছেন, কঠোর শাস্তির বিধান রেখে লাভ নেই, যদি তার যথাযথ প্রয়োগ না করা যায়। তবে সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাংসদ মো. রেজাউল করিম আজগুবি তত্ত্ব হাজির করেছেন। তিনি বলেছেন, নারীমুক্তির নামে নারীবাদীরা নারীদের স্বাধীন হতে উৎসাহিত করছেন। এতে ধর্ষণকারীরা ধর্ষণে উৎসাহিত হচ্ছে। তাঁর আরজি ছিল ‘মাননীয় স্পিকার, আল্লামা শফীর তেঁতুল–তত্ত্ব যদি ব্যবহার করা হয়, তাহলে ধর্ষকেরা নিরুৎসাহিত হবে…এবং তাঁদের মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতি বাড়বে।’ উল্লেখ্য, হেফাজতে ইসলামের প্রয়াত আমির আল্লামা শফী ২০১৩ সালে নারীদের তেঁতুলের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন।
কী ভয়ংকর কথা! সংবিধান বলছে, ‘নারী-পুরুষ নির্বিশেষ প্রত্যেক নাগরিক সম–অধিকার ভোগ করবে। বৈষম্য করা যাবে না।’ আর সেই সংবিধান সমুন্নত রাখার ওয়াদাকারী একজন সাংসদ সংবিধান অমান্য করে তেঁতুল–তত্ত্বে আস্থা রেখেছেন। তাঁর এ বক্তব্যের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছেন নারী ও মানবাধিকার সংগঠনের নেত্রীরা। নারীপক্ষের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য শিরিন হক বলেছেন, যিনি তেঁতুল–তত্ত্বের কথা বলতে পারেন, তিনি ‘অসভ্য লোক’। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম সাংসদের কথাকে ‘সস্তা বুলি’ আখ্যায়িত করে প্রশ্ন রেখেছেন, তাহলে মাদ্রাসায় যাঁরা হিজাব ও বোরকা পরে থাকেন, তাঁরা কেন ধর্ষণের শিকার হন? নারী অধিকারকর্মী খুশী কবির বলেছেন, যাঁরা জনগণের ভোট নিয়ে সংসদে বসেন এবং তাঁদের করের অর্থে বেতন-ভাতা নেন, তাঁদের কাছ থেকে এ রকম দায়িত্বহীন বক্তব্য কাম্য নয়। নারী আইনজীবী সমিতির সভানেত্রী সালমা আলী বলেছেন, নারীর পোশাকের সঙ্গে ধর্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই। এসব বক্তব্য ধর্ষকদের উৎসাহিত করবে।
নারী নেত্রীদের এসব প্রতিবাদ ও আপত্তি প্রকাশের এক দিন পর সাংসদ রেজাউল করিম তাঁর অবস্থান থেকে সামান্যও সরে যাননি। সাক্ষাৎকারে তিনি দাবি করেছেন, অবশ্যই ধর্ষণের সঙ্গে টি-শার্ট পরে রাস্তায় বের হওয়ার সম্পর্ক আছে। সাংসদের চরিত্র বোঝার জন্য সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরছি।
: ‘নারীবাদীদের কারণেই ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে’, আপনার এমন উপলব্ধির কারণ কী?
রেজাউল করিম: নারীবাদী বলতে আমি যা বুঝিয়েছি, সেটি যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে বা সাংগঠনিকভাবে আমলে নেয়, তাহলে তা সঠিক হবে না। ধর্মীয় অনুশাসনকে প্রাধান্য না দেওয়া বা সরকারের নীতিমালার বাইরে যাওয়ার কথা বলেছি। যেমন ধরেন, রাস্তাঘাটে বের হওয়ার সময় আমি যদি একটি সাবলীল পোশাক না পরি, গেঞ্জি পরে যদি চলাফেরা করি, সেটা বুঝিয়েছি।
: সাবলীল পোশাক বলতে কী বোঝাচ্ছেন?
রেজাউল করিম: সাবলীল পোশাক বলতে একজন যুবতী নারী যদি গেঞ্জি পরে রাস্তায় চলাফেরা করেন, তাহলে কেমন হবে?
: এটা কি বাংলাদেশের আইনবিরুদ্ধ হবে?
রেজাউল করিম: আইনের একটা বিষয় আছে, আর সামাজিক একটা বিষয় আছে।
: কোনো একজন নারী বা মেয়ে যদি টি-শার্ট পরে রাস্তায় বের হন, তাহলে তাঁর অপরাধটা কী এবং এর সঙ্গে ধর্ষণের সম্পর্ক কী?
রেজাউল করিম: অবশ্যই ধর্ষণের সঙ্গে টি-শার্ট পরে রাস্তায় বের হওয়ার সম্পর্ক আছে। আল্লাহ সৃষ্টিগতভাবেই নারী ও পুরুষের মাঝে আকর্ষণের সৃষ্টি করেছেন। যখনই কোনো যৌবনপ্রাপ্ত নারী অশালীন পোশাকে রাস্তায় চলাফেরা করবেন, তখন কুরুচিসম্পন্ন মানুষ তাঁদের কুদৃষ্টিতে দেখবে।
: তাহলে তো সমস্যাটা কুরুচিসম্পন্ন মানুষের?
রেজাউল করিম: কিন্তু এই কুরুচিটা সৃষ্টি হয় কোথা থেকে সেটা আমাদের সবাইকে দেখতে হবে।
: আপনার কাছ থেকে বুঝতে চাইছি নুসরাত, তনুরা হিজাব পরতেন, শরীর ঢেকে রাখতেন, টি-শার্ট পরতেন না। তাঁরাও তো ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তাহলে এর ব্যাখ্যা কী?
রেজাউল করিম: সব ক্ষেত্রে একটি বিষয় উদাহরণ হিসেবে নেওয়া যায় না। একটি সার্বিক বিষয় আছে। কুরুচিসম্পন্ন মানুষগুলো যখন রাস্তাঘাটে বিভিন্নজনকে বা অনলাইনে বিভিন্ন খারাপ দৃশ্য, পর্নোগ্রাফি দেখে, তখন তার ভেতরটা কুরুচি দিয়ে ভরে যায়। তাঁদের কুরুচি তৈরি হয় এক জায়গায়, আর তাঁরা তা প্রয়োগ করেন অন্য জায়গায়।
: একজন নারী যদি হিজাব পরেন বা আপনি যেগুলোকে সাবলীল পোশাক বলছেন সেগুলো পরেন, তাহলেই কি সেই কুরুচি দূর হয়ে যাবে?
রেজাউল করিম: না, দূর হবে না। তবে কিছুটা অংশ লাঘব হবে। (ডেইলি স্টার, ১৯ নভেম্বর ২০২০)
এখন পাঠকই বিচার করুন, এই সাংসদের মনের অন্ধকার দূর করা কতটা কঠিন। তিনি ধর্ষণের জন্য নারীবাদীদের দায়ী করেছেন। নারীর পোশাক তথা টি–শার্টকে দায়ী করেছেন। কিন্তু যে মনুষ্যরূপী দুর্বৃত্তরা ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ করে, তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলেননি।
নারীবাদীদের বিরুদ্ধে তাঁর রোষের কারণটিও অনুমান করা কঠিন নয়। নারীবাদীরা ধর্ষকদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, নারী-পুরুষের বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলেন। সামাজিক অনাচার ও পারিবারিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তথাকথিত সালিসের নামে নারীদের ওপর বর্বরোচিত সহিংসতার প্রতিবাদ করেন। নারীর অধিকার রক্ষায় নারীবাদীরা যেসব কার্যক্রম চালাচ্ছেন, রেজাউল সাহেবের তা পছন্দ নয়।
তিনি যে সংসদে দাঁড়িয়ে তেঁতুল–তত্ত্বের পক্ষে কথা বললেন, সেই সংসদ পরিচালনা করছিলেন একজন নারী (স্পিকার)। সংসদ নেতা নারী, সংসদের বিরোধী দলের নেতা নারী। সেই সংসদে সংরক্ষিত নারী আসনে ৫০ জন সাংসদ ছাড়া সরাসরি নির্বাচিত বেশ কয়েকজন নারী সাংসদও উপস্থিত ছিলেন। দুর্ভাগ্য যে কেউ রেজাউল করিমের নারীবিরোধী কথার প্রতিবাদ করেননি।
এ রকম একজন ব্যক্তি কীভাবে আমাদের সর্বোচ্চ সম্মানিত প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদের সদস্য হলেন? বগুড়ায় সাংবাদিক বন্ধুদের সঙ্গে আলাপ করে এবং পুরোনো পত্রিকা ঘেঁটে জানলাম, রেজাউল করিম ফাঁকতালে সাংসদ হয়েছেন। তিনি ছিলেন স্থানীয় একটি পত্রিকার উপজেলা প্রতিনিধি। পরে উপজেলা চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করে মাত্র কয়েক শ ভোট পেয়েছেন। ২০১৮ সালের নির্বাচনে বগুড়া-৭ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল হলে তাঁর কপাল খুলে যায়। অভিযোগ আছে, ওই প্রার্থী মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার আগে উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদে ইস্তফা দিলেও নির্বাচন কমিশন অন্যায়ভাবে তাঁর মনোনয়ন বাতিল ঘোষণা করে। আওয়ামী লীগ ওই আসনটি তাঁর মিত্র জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেয় এবং তারা এমন একজন প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়, যাঁর নির্বাচনে জয়ের কোনো সম্ভাবনা ছিল না। অন্যদিকে বিএনপি জিয়াউর রহমানের জন্মভূমি গাবতলীর এই আসন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীকে দিতে রাজি ছিল না। তাই নির্বাচনের আগে তারা রেজাউল করিমের সঙ্গে সমঝোতা করে যে বিএনপি তাঁকে সমর্থন দেবে এবং নির্বাচনের পর তিনি দলে (বিএনপি) যোগ দেবেন। নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তাঁকে নিয়ে টানাটানিও করেছিল।
কিন্তু বুদ্ধিমান রেজাউল স্বতন্ত্রই থেকে গেছেন। তেঁতুল–তত্ত্ব প্রচারের জন্য সেটাই অধিক সুবিধাজনক মনে করেছেন।
সোহরাব হাসান: প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি
Leave a Reply