নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে (ফেসবুক) স্ট্যাটাস এবং মন্তব্য করা নিয়ে ইদানীং এক ধরনের অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে বরিশালে। ধর্মীয় কিংবা মহান ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অবমাননা এবং কটুক্তির অভিযোগে একাধিকবার উত্তপ্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে সেখানে। ঘটেছে জেল, নির্যাতন এবং প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তির ঘটনাও। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সমাজবিজ্ঞানীরা। এসব স্পর্শকাতর বিষয় যেকোনো সময়ে হানাহানি কিংবা দাঙ্গা সৃষ্টি করতে পারে বলে আশংকা তাদের। তবে পুলিশ প্রশাসন এ ব্যাপারে সচেতন আছে বলে জানা গেছে। একই সঙ্গে সবাইকে ফেসবুক ব্যবহারের ক্ষেত্রে চিন্তাশীল ও সহনশীল হবার আহবান জানান সংশ্লিষ্টরা। সম্প্রতি ফেসবুকে ধর্ম, ব্যক্তি, সামাজিক রীতিনীতি নিয়ে একের পর এক কটুক্তি ও অবমাননার অভিযোগ উঠেছে বরিশালে। মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলায় মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) কে নিয়ে ফেসবুকে আপত্তিকর মন্তব্য করার অভিযোগে এক যুবককে গ্রেপ্তার করা হয়। গত ১০ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় সজল কুমার শীল (২২) নামের ওই যুবককে। তার ফাঁসির দাবিতে থানার সামনে বিক্ষোভ করেন কয়েক শ’ মানুষ।
একই অভিযোগে আগেরদিন (৯ নভেম্বর) বাকেরগঞ্জ উপজেলার চরাদি ইউনিয়নের সুজন চক্রবর্তীর (২৫) ওপর হামলা চালায় এলাকাবাসী। এসময় বিচারের নামে তাঁর চুল কেটে দেয়া হয়। বর্তমানে প্রাণভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সুজন। অন্যদিকে বঙ্গবন্ধু হত্যাকা- নিয়ে ফেসবুকে কটুক্তির অভিযোগে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী মোঃ খালিদ হাসানকে কারণ দর্শানোর নোটিশ (শোকজ) দেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। গত পহেলা নভেম্বর তাঁর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। একইভাবে শোকজ করা হয়েছে সেখানকার কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী তৌহিদ ফেরদৌস শাওনকে। তাঁর বিরুদ্ধে ফেসবুকে ইসলামি বিবাহ রীতি নিয়ে কটুক্তি ও নারী জাতিকে হেয় করে মন্তব্যের অভিযোগ উঠেছে। তাকে স্থায়ী বহিষ্কারের দাবিতে গত ১৮ নভেম্বর মানববন্ধন করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
এ ব্যাপারে বাকেরগঞ্জের সুজন চক্রবর্তী জানান, পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এবং স্ট্যাটাসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে জনরোষ উসকে দিয়েছে একদল এলাকাবাসী। মেহেন্দিগঞ্জের সজলের সঙ্গে যোগাযোগ সম্ভব হয় নি। তবে তাঁর (সজল) একজন স্বজন নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, ফেসবুকের যে স্ট্যাটাস ঘিরে এই উত্তপ্ত অবস্থার সৃষ্টি সেটা সজলের দেয়া নয়। মূলত খোঁজ খবর না নিয়েই এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছে এলাকাবাসী। অন্যদিকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযুক্ত দুজন শিক্ষার্থী গণমাধ্যমে দাবি করেছেন ‘ভুল বোঝাবুঝি’র কারণে তাদের বিরুদ্ধে ফুঁসলে উঠেছেন শিক্ষার্থীরা। এমন অবস্থাকে ‘সাংস্কৃতিক ভারসাম্যহীনতা’ বলে আখ্যা দিয়েছেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মোঃ ওহিদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রযুক্তিগত সমৃদ্ধি হয়েছে ঠিকই কিন্তু সেগুলো ব্যবহার করার মতো বিবেক – বুদ্ধিমত্তার উন্নতি হয় নি। যে কারণে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘিরে সাংস্কৃতিক ভারসাম্যহীন একটা প্রভাব সমাজে দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে অল্পতে পরিচিতি (ভাইরাল) লাভ করার জন্য অনেকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে অযৌক্তিকভাবে ব্যবহার করতে গিয়ে এমন বিতর্ক সৃষ্টি করছে’।
আর এমন অবস্থা নিয়ে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছেন বরিশাল বিএম (ব্রজমোহন) বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক ড. ইব্রাহীম খলিল। তিনি জানান, আমাদের ইতিহাস এদেশে শান্তিপূর্ণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি থাকার কথাই নির্দেশ করে। সেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘিরে বর্তমান সময়ের এমন অস্থিরতার কারণে হানাহানি থেকে শুরু করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি হতে পারে। সেক্ষেত্রে এখন থেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এ ব্যাপারে সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ঘিরে অস্থিরতা রোধে পুলিশ সজাগ আছে বলে জানিয়েছেন বরিশাল জেলার পুলিশ সুপার মোঃ সাইফুল ইসলাম। তিনি বলেন,‘ ফেসবুক ব্যবহার করে কেউ যেন সামাজিক অশান্তি- অস্থিরতা বৃদ্ধি কিংবা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্টের চেষ্টা না করে সে ব্যাপারে সজাগ আছি আমরা। কোন অভিযোগ পাবার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে’। তবে ফেসবুকে যেকোনো স্ট্যাটাস কিংবা মন্তব্য করার আগে সবাইকে চিন্তাশীল হবার পরামর্শ দেন বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার প্রলয় চিসিম।একই সঙ্গে ফেসবুকে প্রচারিত যেকোনো বিষয় নিয়ে সহনশীল আচরণ করার আহবান জানান সাধারণ মানুষদের। পুলিশ এসব ব্যাপারে আইনগত ব্যবস্থা নেবার মাধ্যমেও সচেষ্ট থাকবে বলে জানান তিনি।
Leave a Reply