নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল জগদীশ সারস্বত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয় ১৯২৭ সালে (বর্তমানে স্কুল এন্ড কলেজ)। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে আজ পর্যন্ত স্কুলটিতে কৃষি শিক্ষা বিষয়ে কোন ছাত্রী পড়াশুনা করেনি। এমনকি কৃষি শিক্ষা বিষয়ে শিক্ষা বোর্ডের কোন অনুমোদনও নেই। স্কুলটিতে বোর্ড থেকে অনুমোদন প্রাপ্ত গার্হস্থ্য অর্থনীতি। এমপিও নীতিমালায় উল্লেখ আছে ‘কোন বিষয় যখাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না থাকলে/ কোন বিষয় পর পর শিক্ষার্থী না থাকলে ওই বিষয়ে কোন শিক্ষক এমপিওভূক্ত হতে পারেনা। অথচ জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে ১৯৯০ সালের ১ জুলাই এই স্কুলে কৃষি শিক্ষা বিষয়ে জাহাঙ্গীর হোসেন নামে এক শিক্ষককে নিয়োগ দেয়া হয়। চলতি বছরের ২৯ অক্টোবর সহকারী শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন অবসর গ্রহণ করেন। অর্থ্যাৎ ভুয়া তথ্যের ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে ৩০ বছর চাকরি করে সরকারি কোষাগারের লাখ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন জাহাঙ্গীর হোসেন। জালিয়াতির বিষয়টি প্রথম ধরা পড়ে ২০১১ সালে। ওই সময় স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি ছিলেন বিএম কলেজের সাবেক ভিপি আনোয়ার হোসেন।
তিনি অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেনকে নোটিশ প্রদান করে বেতন বন্ধ করে দেন। কিন্তু ২০১২ সালে যুবলীগ নেতা নিজামুল ইসলামকে এডহক কমিটির আহবায়ক করায় অবৈধ শিক্ষক পুনরায় বৈধতা পায়। তিনি (নিজাম) স্কুলের এফডিআর ভেঙ্গে জাহাঙ্গীন হোসেনসহ স্কুলের সকল শিক্ষক-কর্মচারীর ১৩ মাসের বেতন পরিশোধ করেন। চলতি বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীর হোসেনের বেতন-ভাতা বন্ধসহ তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক বরাবরে গভর্নিংবডির সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন লিখিত অভিযোগ করেন। অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, ‘জগদীশ সারস্বত স্কুল এন্ড কলেজের স্কুল শাখায় জাহাঙ্গীর হোসেন ১৯৯০ সালের ১ জুলাই অবৈধভাবে যোগদান করে দাপটের সাথে চাকরি করে সরকারের কোষাগার থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। যা সম্পূর্ন অবৈধ ও বেআইনী। কারণ জগদীশ সারস্বত স্কুল এন্ড কলেজের সকল ছাত্রীরা গার্হস্থ্য বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা করে আসছে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে।
গার্হস্থ্য অর্থনীতি বিষয়টি বোর্ড থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত। অত্র প্রতিষ্ঠানে প্রতিষ্ঠাকাল থেকে কৃষি শিক্ষা বিষয়ের কোন অনুমোদন নেই এবং কোন শিক্ষার্থীও নেই। তাছাড়া তিনি যে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পেপার দাখিল করেছেন তাতে তার চাকরি হয়না’। অবসরজনিত কারণে সহকারী শিক্ষকের পদ শূন্য হওয়ায় ১৯৮৯ সালের ৭ ডিসেম্বর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় দুইজন শিক্ষক চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে জগদীশ সারস্বত বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ (বর্তমানে স্কুল এন্ড কলেজ)। বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ আছে ‘দশম শ্রেনীতে ইংরেজী ও অংক পড়াইতে সক্ষম সরকারী বেতন স্কেলে দুইজন বিএ/বিএসসি/ বিএড শিক্ষক/শিক্ষিকা আবশ্যক’। বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী ইংরেজী বিষয়ে ক্ষিরোদ লাল কর (ইনডেস্ক-১৯১৯২১) এবং গনিত বিষয়ে বিজয় কৃষ্ণ ঘোষকে (ইনডেস্ক-২০৯৯৩৯) নিয়োগ প্রদান করা হয়। কিন্তু এই দুই বিষয়ে মো. জাহাঙ্গীর হোসেনকে নিয়োগ প্রদানের কোন প্রমান নেই। তাছাড়া তার এমপিওতে ইনডেস্ক নম্বরের পূর্বে অএঞ-২০৫৬৪৭ লেখা রয়েছে। যা তাকে কৃষি বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে পরিচিত করে। এতে প্রমানিত হয় যে জাহাঙ্গীর হোসেনের নিয়োগ প্রক্রিয়া সরকারী বিধি মোতাবেক হয়নি।
এমপিও নীতিমালায় উল্লেখ আছে ‘কোন বিষয় যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি না থাকলে/ কোন বিষয় পর পর শিক্ষার্থী না থাকলে ওই বিষয়ে কোন শিক্ষক এমপিওভূক্ত হতে পারেনা। জাল জালিয়াতির মাধ্যমে এমপিওভূক্ত হলেও বেতন ভাতা নিতে পারেন না। ভুলক্রমে বা জালিয়াতির মাধ্যমে এমপিওভূক্ত হয়ে বেতন-ভাতা উত্তোলন করলে প্রতিষ্ঠান প্রধান ও সভাপতি যৌথভাবে সরকারের নিকট দায়ী থাকবেন। অভিযোগের প্রেক্ষিতে গত ৫ নভেম্বর শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেনের সরকারি ও অভ্যন্তরীন বেতন-ভাতা বন্ধসহ তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে প্রধান শিক্ষককে চিঠি প্রেরণ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (স্মারক নং-৩৭.০২.০০০০.১০৭.৯৯.১৮.২০২০/১৩০২)। মাউশির শিক্ষা কর্মকর্তা (মা-২) স্বাক্ষরিত চিঠিতে বর্নিত শিক্ষকের নিয়োগ সংক্রান্ত মূল কাগজ পত্রাদি দশ কার্য দিবসের মধ্যে পরিচালক (মাধ্যমিক) কক্ষে প্রদর্শনের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে স্কুলের প্রধান শিক্ষক শাহ আলম বলেন, ‘মাউশির চিঠি পেয়েছি এবং বিষয়টি সংশ্লিষ্ট শিক্ষককে অতি শীঘ্রই চিঠির মাধ্যমে অবহিত করা হবে। এদিকে একই অভিযোগ এনে গত ৫ অক্টোবর বরিশাল জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার বরাবরে লিখিত অভিযোগ দেন স্কুলের সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন। অভিযোগ দখিলের পর বরিশাল জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আনোয়ার হোসেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে বিষয়টি তদন্তের জন্য ৩ নভেম্বর চিঠি প্রেরণ করেন (স্বারক নং-১০৪৪)। গত ২২ নভেম্বর অভিযোগকারী আনোয়ার হোসেন, অভিযুক্ত শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেন এবং প্রধান শিক্ষক শাহ আলমের উপস্থিতিতে প্রাথমিকভাবে তদন্ত কাজ শুরু করেন উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা। এসময় সেখানে একাডেমিক সুপার ভাইজারও উপস্থিত ছিলেন। তারা উভয় পক্ষের কথা মৌখিকভাবে শোনেন এবং কাগজপত্র যাচাই বাছাই করে প্রত্যেককে লিখিত বক্তব্য প্রদানের জন্য নির্দেশ দেন। মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার বীথিকা সরকার বলেন, ‘উভয় পক্ষকে লিখিত আকারে সব কাগজপত্র এক সপ্তাহের মধ্যে জমা দিতে বলা হয়েছে। একাডেমিক সুপার ভাইজার সুচিত্রা সরকার বলেন, ‘সবার কথা মৌখিকভাবে শোনা হয়েছে। প্রত্যেককে লিখিত বক্তব্য জমা দিতে বলেছি। কাগজপত্র দাখিল হওয়ার পর জাস্টিফাই করা হবে। অভিযোগকারী ও স্কুল ম্যানেজিং কমিটির সাবেক সভাপতি আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমি সভাপতি থাকাকালীন ২০১১ সালে জালিয়াতির বিষয়টি ধরা পড়ে। এরপর আমি শিক্ষক জাহাঙ্গীর হোসেনকে নোটিশ করে বেতন বন্ধ করে দেই। তিনি ১৩ মাস বেতন নিতে পারেননি। এরপর আমার বিরুদ্ধে তারা আন্দোলন শুরু করে। পরবর্তীতে এডহক কমিটির আহবায়ক করা হয় যুবলীগ নেতা নিজামুল ইসলামকে।
তিনি অবৈধভাবে স্কুলের এফডিআর ভেঙ্গে বেতন ভাতা পরিশোধ করেন যা ছিল সম্পূর্ন অবৈধ। কারণ এডহক কমিটির এফডিআর ভাঙ্গার কোন এখতিয়ার নেই। আনোয়ার হোসেন জানান, জাহাঙ্গীর হোসেনের নিয়োগ থেকে শুরু করে সবকিছুই ভুয়া। জেলা শিক্ষা অফিসেও তার কোন কাগজপত্র নেই। ভুয়া তথ্য দিয়ে তিনি এমপিওভূক্ত হয়েছেন।
অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, এসব আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। আনোয়ার হোসেন এবং প্রধান শিক্ষক শাহ আলম জাল স্বাক্ষর করে আমার বিরুদ্ধে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে হয়রানী করছেন। এ ব্যাপারে জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকতা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বরিশাল অঞ্চলের উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘ জগদীশ সারস্বত স্কুল এন্ড কলেজের একজন সহকারী শিক্ষকের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়েছি। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পরে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
Leave a Reply