নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ প্রতিবছর কার্তিক-অগ্রহায়ন মাসে কৃষকদের ধান কাটার সময় আসলেই বরিশাল মেঘনা নদীর চরে শুরু হয় বিভিন্ন ডাকাত দল ও লাঠিয়াল বাহিনীর তান্ডবলীলা। কৃষকদের পাকা ধান, সবজি, খামারের গরু, মহিষ সব কিছুই টেনে হেছড়ে নিয়ে যায়। অস্ত্র ও ঢাল-তীর’র মহড়া দিয়ে আতংকে রাখা হয় কৃষকদের। বাধা দিলেই কৃষকের প্রান যায় ছুরির নিচে। সম্প্রতি দুই কৃষককে জবাই করে লাশ গুম,১০ জনকে জখম , ৫০জনকে পিটিয়ে আহত ও অস্ত্রের মূখে গরু-মহিষ লুট করে এবছর’র কার্তিক মাসের যাত্রা শুরু করেছে ডাকাত-লাঠিয়াল বাহিনীর সদস্যরা। এদিকে দীর্ঘদিন নদী ভাঙ্গনে বরিশাল মেহেন্দিগঞ্জ ও ভোলা সদর এবং লক্ষীপুর অংশের সীমানা নির্ধারন করা না থাকায় আধিপত্য বিস্তার ও পাঁচ হাজার একর চরের বিশাল সম্রাজ্যের নিয়ন্ত্রন ধরে রাখতে লাঠিয়াল বাহিনীর তিন জেলার তিনটি দল চরের কৃষকদের ওপর ত্রিমূখী হামলা লুটপাট চালায়। যার দরুন,সাধারন কৃষক ও জমির মালিকদের দিন কাটছে উদ্বেগ উৎকন্ঠায়। ভাবনায় ফেলেছে এবারও সব ফসল ডাকাতরা নিয়ে যাবে কিনা?।
বিস্ময়কর বিষয় হচ্ছে,চরকে ডাকাত ও লাঠিয়াল মুক্ত রাখতে বরিশাল পুলিশ প্রশাসনের কাছে অভিযোগ করলেও ক্ষমতাধর লাঠিয়ালদের নিয়ন্ত্রনে আনতে বারবার ব্যর্থ স্থানীয় থানা পুলিশ । সেইসাথে বিছিন্ন এলাকা হওয়ায় দুই জেলার ডিসিদের কাছে সেলিম রাঢ়ীসহ একাদিক ব্যক্তি আবেদন করেও সীমানা নির্ধারন বিষয়ে সুরাহা না পাওয়ায় বরিশাল-ভোলা-লক্ষীপুরের বাসিন্দাদের মধ্যে লেগেই থাকে দ্বন্ধ। যার খেসারত দিতে হয় সাধারণ কৃষকদের। বরিশাল মেহেন্দিগঞ্জের সামসু- তারেক ,লক্ষীপুরের লুলা হারিচ-জাকির-ইমাম,ভোলা জেলার আলতু-রাসেল- ওহাব একে অপরের বিরুদ্ধে লুটপাট ও লাঠিয়াল বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছে বলে ক্ষতিগ্রস্থ চরবাশি এধরনের তথ্য তুলে ধরেন।
থানা পুলিশের তথ্যে দেখা গেছে, এদের সবার বিরুদ্ধে ডাকাতি-লুটপাট-হামলা ও বাহিনী নেতৃত্ব দেওয়ার মামলা রয়েছে। তথ্য সূত্রে জানা যায়, লাঠিয়াল বাহিনীর হাত থেকে এবারকার চরের পাকা আমনসহ সবজি, গরু/মহিষ রক্ষায় পুলিশের সহায়তা চেয়ে বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি সফিকুল ইসলামের কাছে ১৬ নভেম্বর-২০২০ইং তারিখ লিখিতভাবে মেহেন্দিগঞ্জের বাসিন্দা মহিউদ্দিন,সাহাবুদ্দিনসহ ২১জন মিলে গন অভিযোগ করেন।
একইদিনে বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি কার্যকর ব্যবস্থা নিতে ভোলা পুলিশ সুপারকে নির্দেশ করেন। অভিযোগের খবর লাঠিয়াল বাহিনীর মধ্যে ছড়িয়ে পড়লে আধিপত্য ধরে রাখতে ২৩ নভেম্বর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেঘনার উদয়পুর চরে শুরু হয় তান্ডব। গরু-ছাগল-হাঁস মুরগি লুটসহ রাসেল বাহিনীর প্রধান রাসেলের পরিবারের সদস্য জাহানারা বেগম (৭৫),মরিয়ম(৪৮),আবুল কালাম(৮০),মিন্টু খাঁ ও আব্দুল কাদের নামের ৫জনকে কুপিয়ে জখম করা হয়। একই সময় শেখ ফরিদ ও রাকিব নামে দু’জন গুম হয়েছে। এই গুম হওয়া দুজনের মধ্যে শেখ ফরিদ লক্ষীপুরের হারিচ হারিচের ছেলে। এ ঘটনায় ভোলা সদর থানায় আলমগির হোসেন নামে হারিচের অপর ছেলে রাসেলকে প্রধান আসামি করে প্রায় ৩০/৪০ জনকে অজ্ঞাত করে বাদি হয়ে মামলা দায়ের করেন।
রাসেল বাহিনীর প্রধান রাসেল অভিযোগ করে বলেন, পৈত্তিক ভিটা নদী গর্ভে বিলীন হয়েছিল। এখন চর পড়েছে,তাই পরিবার নিয়ে চরে থেকে চাষাবাদ করি। কিন্তু লক্ষীপুরের লুলা হারিচ বাহিনী,ভোলার আলতু-ওহাব বাহিনী চরে ভূমি মালিক ও কৃষকদের আসতে দেয় না। যারা চাঁদা দেয় তাদের চরের জমিতে চাষ করতে দেওয়া হয়।
চাঁদা দেইনা বলে আমর পরিবার ও কর্মচারিদের কুপিয়ে জখম করা হয়েছে।
এঘটনায় তিনি থানায় মামলা করবেন বলে জানান। এদিকে ভোলার আলতু ও ওহাব জানান,আমার বাপ দাদার ভিটা মাটি ছিলো চরে। সেখানে চাষাবাদ করতে গেলে রাসেল বাহিনী,লক্ষীপুরের জাকির-ইমাম একাট্রা হয়ে চরে সাধারণ কৃষকদের কাছ থেকে চাঁদাবাজি করে। মারামারির ঘটনার দিন রাসেল খাঁ বাহিনী দুই কৃষকে গুম করেছে ।
লক্ষীপুরের হারিচ জানান,আমার ছেলেকে রাসেল খাঁ বাহিনী গুম করেছে। আমি এখন নদীতে ও চরে আমার ছেলের লাশ খুজে বেড়াচ্ছি। উদয়পুর চরের সাধারণ কৃষক মোক্তার,ফারুক,সলিমসহ আরো অনেকেই জানান,কার্তিক অগ্রহায়ন মাসে আমন ধান পাকলেই ঘুমিয়ে থাকা দৈত্যদের মতো লাঠিয়ালদের ঘুম ভাঙ্গে। মারামারি কাটাকাটি শুরু হয়ে যায় । বাৎষরিক চাঁদা না দিয়ে আমরা কেউ চাষাবাদ করতে পারিনা। ভোলা সদর থানার ওসি এনায়েত হোসেন জানান,গুম হওয়া দু’জনকে মৃত অথবা জীবিত উদ্ধার করতে পারিনি। তবে আমরা,যাদের বিরুদ্ধে গুমের অভিযোগ তাদের মধ্য থেকে কাদের ও মিন্টু খাঁ নামে দুজনেকে আটক করে জেল হাজতে প্রেরন করেছি। আর রাসেলের পরিবারের যারা আহত হয়েছে তারা মামলা করতে আসলে আমরা মামলা নেব।
অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে,মেঘনা নদীর বরিশাল মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলা,ভোলা সদর ও লক্ষীপুর সীমানার মোহনায় ৫ হাজার একর বিস্তৃত এলাকাজুড়ে চর জেগে উঠেছে। তিন জেলার প্রায় এক লাখ সাধারণ মানুষের অংশিদারিত্ব রয়েছে। ভাঙ্গনের সময়ে বিভিন্ন এলাকায় অবস্থান নেয়া মানুষ,জেগে ওঠা চরের নিজ ভূমিতে ফিরে আসতে চাইলেও চরাঞ্চলের সন্ত্রাসের কারনে ভয়ে কেউ সামনে আসে না। লাঠিয়ালদের দানবীয় কর্মকান্ডে তিন জেলার সীমানা পর্যন্ত নির্ধারণ করা সম্ভব হয়নি। চর এলাকার সাহেব আলী,বাচ্চু মাঝি,আবুল কালাম,মেঘা চরের জাহাঙ্গীর আকন, সালু ঢালী,কাশেম ঘোষ, হুমায়ুন জমাদ্দার,নোয়াখালী এলাকার গোধা নামের এরা সবাই কয়েক হাজার মহিষ পালন করেন। মেহেন্দিগঞ্জ গোবিন্দপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা (বর্তমানে উলানিয়া থাকে) সামছুউদ্দিন গাজী ওরফে সামসু ও তারেককে চাঁদা দিয়ে চরে মহিষ পালন করেন। লক্ষীপুর জেলার হারিচ-জাকির-ইমাম ও ভোলার আলতু-রাসেল বাহিনীর ভিন্ন ভিন্ন তিনটি লাঠিয়াল গ্রুপ রয়েছে।
এরা কৃষক ও ভূমি অংশিদারদের কাউকেই চরে আসতে দেয় না । যারা টাকা দেয় তাদের সীমানা নির্ধারন করে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য থাকতে দেওয়া হয়। সে ক্ষেত্রে যারা মহিষ বা গরু পালন করে এক জোড়া মহিষ/গরু লালন পালনের জন্য বাৎসরিক ৫ হাজার টাকা দিতে হয়। তারা প্রত্যেকেই লাঠিয়াল বাহিনীর কাছে মহিষ পালনে প্রতিজোড়া বাবদ টাকা পরিশোধ করেন।
আর কেউ কৃষি কাজ করলে প্রতি দেড় একর জমিতে স্থান ভেদে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকা দাদন নেয়। আর যারা টাকা না দিয়ে চাষাবাদ করে,চাষ শুরুর সময় কিছু বলা হয় না। যখন ধান পেকে যায় এবং সবজি চাষের ফলন আসে তখনই এসব বাহিনী হামলা লুটপাট শুরু করে। একই সাথে বেশ কয়েকটি স্পটে চরের মধ্যকার ছোট ছোট নদীর মতো রয়েছে। জোয়ারে মাছ ঢুকে পড়ে সেখানে। একেক মৌসুমে ৫০ লাখ টাকা করে দাদন দিয়ে মাছ ধরতে হয় জেলেদের। ১২/১৩ টি ইলিশের মাছ ঘাটও তাদের নিয়ন্ত্রনাধীন। এই সন্ত্রাসের নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ বছরের ইতিহাস। এর আগে চর এলাকা নিয়ন্ত্রন করতো মেহেন্দিগঞ্জের আলতু সরদার’র লাঠিয়াল গ্যাং। তিনি মারা যাওয়ার পর সম্প্রতি ৪ বছর যাবৎ এ সম্রাজ্যের হাল ধরেছে,তার বড় ছেলে তারেক। সঙ্গে রয়েছে ক্যাডার সামছু সরদার। এদিকে মেহেন্দিগঞ্জের আলতু সরদার মারা যাওয়ার পর লক্ষীপুরের হারিচ-জাকির-ইমাম বাহিনী ও ভোলার আলতু বাহিনীর উত্থান ঘটেছে। এরসাথে ভোলা রাজাপুর ইউনিয়নের সাবেক এক ইউপি মেম্বর ওহাব চৌকিদার’র নাম শোনা ডাকাত দলের সাথে সঙ্গ দেওয়ার।
দুর্গম এলাকার এসব খবর পুলিশ কর্তাদের কান পর্যন্ত আসলেও কার্যকর কোন বযবস্থা নিচ্ছে না। মূলত চর-অঞ্চলের লাঠিয়াল বাহিনীর বিস্তৃত নেটওয়ার্ক-শক্তিমত্তা-কোটি কোটি টাকার আয়-ব্যয়ের সামনে পুলিশ প্রশাসন অনেকটা দুর্বল। রিয়াজ হাওলাদার বরিশালে ভাড়া বাসায় থাকেন। তাদের পিতৃ ভিটা ছিলো মেহেন্দিগঞ্জ জেগে ওঠা চরে। তার বাবা ও চাচাদের বংশের প্রায় ৫’শ একর জমি রয়েছে সেখানে। অথচ লাঠিয়াল বাহিনী দিয়ে হুমকি দিচ্ছে। জমির মালিক ও কৃষকরা জমি ভোগ করতে গেলে তাদের ওপর হামলা করে হাত পা ভেঙ্গে দেওয়া হয় । ভীতিকর পরিস্থিতির কারনে আমরা বংশের কেউ চরের জমি ফসল চাষ কিংবা বসবাস করতে পারছি না। মেহেন্দিগঞ্জ গোবিন্দপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন তালুকদার জানান,তার ইউনিয়নের প্রায় ২০ হাজার মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে আছে। সীমানা নির্ধারন না হওয়ায় চরে হাঙ্গামা লেগেই থাকে। তবে অজ্ঞাত কারনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তিনি মুখ খুলতে চাইছেন না। ভোলা রাজাপুরের সাবেক ইউপি সদস্য ওহাব আলী বলেন,চরের জমিতে সাধারণ মানুষ ভিড়তে পারে না। পিটিয়ে/কুপিয়ে নদীতে ফেলে দেয়। তাই আমরা এলাকার মানুষ
সেখানে যাচ্ছি না। হাইকোর্টে মামলা (মামলা নং-৬৫৭৫/১২) করেছি। ডিসির কাছে আবেদনের পর বিভাগীয় কমিশনারের কাছে মার্ক করে দিয়েছিল । সন্ত্রাসীদের শক্তির সামনে তারাও আর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। ভোলা সদরের রাজাপুর ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মিজান খান বলেন,চরের জমিতে তার এলাকার প্রায় ২০ হাজার মানুষের অংশিদারিত্ব আছে। তার নিজেরও জমি রয়েছে। চাষাবাদ কিংবা বসবাস করতে গেলে সন্ত্রাসী বাহিনি হামলা করে মালামাল লুটপাট করে নিয়ে যায়। জেলেরা মাছ ধরতে গেলে টাকা নেওয়া হয়। যেখানে মাছের অভয়অরেণ্য সেখানে ৫০ লাখ,৭০ লাখ টাকায় গাড়া ( ভাটার সময় নদীর মাঝে গাছ গেড়ে জাল পেতে নদীর মুখ আটকে রেখে মাছ ধরা) পাততে দেওয়া হয়। ভোলা ডিসির
কাছে সীমানা নির্ধারণ ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আবেদন করেছিলাম।
এছাড়াও এ সন্ত্রসী বাহিনীর বিরুদ্ধে ভোলা থানায় ৪টি ডাকাতি/লুটপাট মামলা করেছি। কিন্তু কোন প্রতিকার পাইনি। তাই এখন আর চরে যাচ্ছি না। অথচ ৫ হাজার একর এলাকার বিস্তৃত চর কৃষি ও বসবাসের জন্য খুবই উপযোগি। ওই চরে কৃষকরা ফসল চাষ করতে পারলে পুরো বরিশাল বিভাগের মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটানো সম্ভব। বরিশাল- ৪ আসনের (মেহেন্দিগঞ্জ) সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ বলেন ,এক শ্রেনির ভূমি দস্যূরা চর দখল নিয়ে মারামারি হাঙ্গামা করে। তাদের কোন ভাবেই রুখে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এদের দস্যূতার দায় আমি নেব না। আমি বরিশাল বিভাগীয় কমিশনারকে বলেছি ব্যবস্থা নিতে। মন্ত্রণালয়ে ডিও লেটার দিয়ে জরিপ করে সীমানা নির্ধারণ করার জন্য। আর ডিসিরা এ্যাকশন নিলে দ্রুত সমাধান সম্ভব হতো। বরিশাল জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাইদুল ইসলাম জানান, সন্ত্রাসীরা চর দখল করে আছে। বরিশাল জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল ইসলাম জানান, লাঠিয়াল বাহিনী ও সন্ত্রাসের
বিরুদ্ধে নজরদারি রয়েছে। তবে চর এলাকার সীমানা নির্ধারন না হওয়ার কারনে ব্যবস্থা নিতে সমস্যা হচ্ছে। দুই জেলার ডিসি এ সমস্যা সমাধান করবেন।
ভোলা জেলার পুলিশ সুপার সরকার মোহাম্মদ কাওছার হোসেন জানান। বরিশাল জেলার ডিসি এস এম অজিয়র রহমান জানান,চরে হারিচ-রাসেল খাঁ-আলতু-তারেক বাহিনী রয়েছে। এদের দমন করতে আমরা কৌশলগত ব্যবস্থা হাতে নিয়েছি। যাতে করে মেঘনার সম্ভাবনাময় চর সন্ত্রাস মুক্ত হতে পারে। বরিশাল রেঞ্জ ডিআইজি সফিকুল ইসলাম বলেন, পুলিশ কৃষকদের পাশে আছে। কার্যকর ব্যবস্থা নিতে সাহস রেখে ভূক্তভোগিদের থানায় বা তার কাছে অভিযোগ করার আহবান জানান।
Leave a Reply