বিদেশ ডেস্ক ॥ ‘প্রক্সিওয়ার’ শব্দের বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘ছায়াযুদ্ধ’। একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে জড়িয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। গত শতকের ষাটের দশকের শুরুতে কিউবার ক্ষেপণাস্ত্র সংকট এর অন্যতম উদাহরণ। সোভিয়েত পতনের মধ্য দিয়ে সেই ছায়াযুদ্ধের আপাত অবসান হলেও বিশ্বরাজনীতির মঞ্চে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে নতুন করে চ্যালেঞ্জ জানায় চীন। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার পথে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে শুরু হয় প্রভাব বিস্তারের নতুন লড়াই। আর এ কৌশলগত লড়াইয়ের অন্যতম মঞ্চ হিসেবে দুই পক্ষ বেছে নেয় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াকে। ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোকে চীনের ‘উঠান’ বলা যায়; বরং এ অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র বহিরাগত শক্তি। অনেকটাই যেন সাগর পেরিয়ে এসে জুড়ে বসেছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মানুষ এখন স্পষ্টতই দেখতে পাচ্ছে, এ অঞ্চলের ওপর চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব। দুই পরাশক্তি এ অঞ্চলের দেশগুলোতে নিজস্ব কৌশলগত প্রভাব প্রতিষ্ঠায় তৎপর। মিয়ানমারের অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতি দেখুন, যুক্তরাষ্ট্র তাৎক্ষণিকভাবে নিন্দা জানিয়েছে। অং সাং সু চির মুক্তি দাবি করে বাইডেন প্রশাসন জান্তা সরকারের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অন্যদিকে চীন এ ইস্যুতে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিন্দা প্রস্তাব আটকে দিয়েছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট রদ্রিগো দুতার্তে একসময় মার্কিনপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০১৬ সালে প্রকাশ্য ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘ফিলিপাইন মার্কিন বলয় থেকে বেরিয়ে আসবে।’এরপরই দুতার্তে বেইজিংমুখী পথে যাত্রা করেন। অন্যদিকে হংকং ও তাইওয়ানের চীনবিরোধী পক্ষকে প্রকাশ্যে সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে ওয়াশিংটন। এমন আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে, যেখানে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোয় কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের ছায়াযুদ্ধে কখনো চীন এগিয়ে গেছে, কখনো যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু প্রশ্ন হলো, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোই কেন ছায়াযুদ্ধ মঞ্চ হলো? এর পেছনে ঐতিহ্যগত, ভৌগোলিক এবং বাণিজ্যিক কারণ রয়েছে। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সম্মিলিত জনসংখ্যা ৭০ কোটির বেশি, যা লাতিন আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চেয়ে বেশি। একসময়ের দরিদ্র কয়েকটি দেশ কৃষি, শিল্প ও পর্যটনে ভর করে গত কয়েক দশকে অভূতপূর্ব উন্নতি করেছে। বিশেষত ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন ও সিঙ্গাপুরের আর্থসামাজিক উন্নয়ন বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। গত এক দশকে এসব দেশের অর্থনীতির ৫-৭ শতাংশ বিকাশ ঘটেছে। মিয়ানমার ও কম্বোডিয়ার অগ্রগতিও চোখে পড়ার মতো। বৈশ্বিক উৎপাদন কেন্দ্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে এ অঞ্চলের কয়েকটি দেশ। আয় বেড়েছে এসব দেশের জনগণের। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে ভোক্তা ব্যয়। তাই এ অঞ্চলের উদীয়মান বাজার চীন-যুক্তরাষ্ট্র দুই পক্ষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। বাজার দখলের এই প্রতিযোগিতা দুই পক্ষকে ছায়াযুদ্ধে জড়াতে প্রভাবিত করেছে। ছায়াযুদ্ধের আরেকটি প্রভাবক দক্ষিণ চীন সাগরের ভৌগোলিক অবস্থান। চীন এ সাগরের বড় একটি অংশ নিজেদের অংশ বলে দাবি করে আসছে। এতে আপত্তি রয়েছে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ কয়েকটি দেশের। চলছে দীর্ঘদিনের বিরোধ। যুক্তরাষ্ট্র এ ইস্যুতে এসব দেশকে সমর্থন জোগায়। চীনের জ্বালানি, কাঁচামাল ও পণ্য বাণিজ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রুট এ সাগর। স্বাভাবিকভাবে বাণিজ্যরুটের নিয়ন্ত্রণ ও নিরাপত্তা রক্ষায় বেইজিং সর্বদা সচেষ্ট। এ জন্য দক্ষিণ চীন সাগরে সামরিক উপস্থিতি জোরদার করেছে চীন। এ জলপথে সামরিক উপস্থিতি রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রেরও। দেশটি এ অঞ্চলে চীনের বিপরীতে নিজেদের প্রভাব ধরে রাখা ও আঞ্চলিক মিত্রদের নিরাপত্তা দিতে দক্ষিণ চীন সাগরে পারমাণবিক অস্ত্র বহনে সক্ষম নৌবহর মোতায়েন করে রেখেছে। প্রশান্ত ও ভারত মহাসাগরের প্রবেশের জলপথে পাহারা বসিয়েছে দুই পক্ষই। মাঝেমধ্যে এ অঞ্চলে চীন-যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক অবস্থান রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে। তবে বড় ধরনের কোনো অঘটন এখনো ঘটেনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধের পর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সরাসরি কোনো সংঘাতে জড়ায়নি মার্কিন প্রশাসন। চীনের অবস্থানও মোটামুটি একই। চীনের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব সাউথ চায়না সি স্টাডিজের জ্যেষ্ঠ গবেষক চেন জিয়াংমিয়াও বলেন, এ অঞ্চলে পরস্পরের উপস্থিতি ও সক্ষমতার বিষয়ে চীন-মার্কিন দুই পক্ষই সচেতন। তারা জানে, সংঘাত তৈরি হলে এর প্রভাব কত দূর গড়াবে। পরিণতি কতটা ভয়াবহ হবে। মূলত এ কারণেই তীব্র রেষারেষি থাকা সত্ত্বেও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে উত্তেজনা দেখা গেছে। রক্ত ঝরেনি। এ অঞ্চলে পরস্পরের উপস্থিতি ও সক্ষমতার বিষয়ে চীন-মার্কিন দুই পক্ষই সচেতন। তারা জানে, সংঘাত তৈরি হলে এর প্রভাব কত দূর গড়াবে। ছায়াযুদ্ধের অংশ হিসেবে এ অঞ্চলের দেশগুলোয় বিনিয়োগের ডালা নিয়ে হাজির রয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। দুই দেশের পণ্যে এ অঞ্চলের বাজার এখন সয়লাব। করপোরেট ব্যবসা থেকে সামরিকায়ন, অবকাঠামো উন্নয়ন থেকে আর্থসামাজিক উত্তোরণ—সব খাতেই দুই পরাশক্তির বিনিয়োগ, প্রভাব ও উপস্থিতি সুস্পষ্ট। দেশে দেশে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের পসরা উপস্থাপনের মাধ্যমে কৌশলগত প্রভাব বিস্তারের দ্বার উন্মুক্ত রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এখানে চীনের একটা কৌশলগত দুর্বল অবস্থান রয়েছে। দীর্ঘসময় ধরে বিনিয়োগ প্রবাহের পাশাপাশি এ অঞ্চলের দেশগুলোয় শ্রমশক্তির স্থানান্তর ঘটিয়েছে চীন। বিশেষত মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়ার জনমিতিতে অভিবাসী চীনা জনগোষ্ঠীর আধিক্য এখন চোখে পড়ার মতো। অনেক ক্ষেত্রেই তা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ক্ষোভের কারণ। এ থেকে চীনবিরোধী মনোভাব তৈরি হয়েছে অনেক দেশে। ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়ায় চীনা অভিবাসনবিরোধী বিক্ষোভ হয়েছে। স্থানীয় ব্যক্তিরা মনে করছেন, চীনারা বাইরে থেকে এসে চাকরি-ব্যবসায় নিজেদের প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছে, যা স্থানীয়দের কাজের সুযোগ কমিয়ে দিয়েছে। যদিও এ ক্ষোভের আগুন সামাল দিতে বেইজিং বেশ সচেতন। ছায়াযুদ্ধের আরেকটি প্রভাবক দক্ষিণ চীন সাগরের ভৌগোলিক অবস্থান। চীন এ সাগরের বড় একটি অংশ নিজেদের অংশ বলে দাবি করে আসছে। এতে আপত্তি রয়েছে মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইনসহ কয়েকটি দেশের। চলছে দীর্ঘদিনের বিরোধ। যুক্তরাষ্ট্র এ ইস্যুতে এসব দেশকে সমর্থন জোগায়। দুই পরাশক্তির এমন প্রতিযোগিতা, ছায়াযুদ্ধ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো অগ্রযাত্রায় ভূমিকা রেখেছে, রাখছে—তাতে সন্দেহ নেই। তবে অনেক সময়ই তা এসব দেশের সামনে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে। বিশেষত যেসব দেশ প্রকাশ্যে কোনো প্রভাববলয়ে যুক্ত হয়নি, তাদের বিদেশ নীতিকে ভারসাম্য বজায় রাখার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়। এ চাপ সামলাতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো আঞ্চলিক ঐক্যের প্রতি জোর দিয়েছে। ইইউর আদলে এ অঞ্চলের ১০টি দেশ গঠন করেছে আঞ্চলিক জোট আসিয়ান। এ জোটের স্লোগান হলো, ‘ওয়ান ভিশন, ওয়ান আইডেনটিটি, ওয়ান কমিউনিটি’। চীন ও যুক্তরাষ্ট্র—দুই পক্ষই আসিয়ানের সঙ্গে কৌশলগত সম্পর্ক উন্নয়নে তৎপর। তারা মনে করে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারের লড়াইয়ে এগিয়ে থাকতে আসিয়ানের সঙ্গে সুসম্পর্কের বিকল্প নেই। যুক্তরাষ্ট্র জোটভুক্ত দেশগুলোকে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার মতো এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা ও তা এগিয়ে নিতে উৎসাহ দেয়। এটা যুক্তরাষ্ট্রর আরেকটি কৌশল। কেননা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ওয়াশিংটনের অন্যতম এশীয় মিত্র, অংশীদার। এসব দেশের সঙ্গে আসিয়ানের কৌশলগত সুসম্পর্ক আখেরে চীনের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের লাভের পাল্লা ভারী করবে।
Leave a Reply