ঝালকাঠি প্রতিবেদক ॥ ঝালকাঠির সুগন্ধা, বিষখালী ও গাবখান নদীর মোহনায় প্রস্তাবিত ইকোপার্কে অস্থায়ীভাবে বসবাস করছেন অনেকগুলো বেদে পরিবার। কয়েকটি বহর নিয়ে এখানে তারা আশ্রয় নিয়েছেন। তারই একটি বহরের সর্দার মো. আশরাফ আলী (৩৫)। ১৮ বছর বয়সে তিনি দাম্পত্য জীবন শুরু করেন। ইতোমধ্যে তাদের সংসারে ৪ ছেলের জন্ম হয়। বড় ছেলে আশিক আহমেদ স্বাক্ষরজ্ঞান সম্পন্ন, মেজ ছেলে আতিকুল ইসলাম কোরআনের হাফেজ ও যাত্রাবাড়ী কওমি মাদরাসার ছাত্র। তৃতীয় জন মো. হুসাইন আহমেদ (১৪) কোরআন দেখে শুদ্ধভাবে পড়া শিখে (ক্বারিয়ানা) এখন পঞ্চম পারায় হেফজ পড়ছে। আর ছোট ছেলে হাসান আহমেদ (১২) কোরআন দেখে শুদ্ধভাবে (ক্বারিয়ানা)পড়তে পারে।
বেদে বহরে কখনও ডাঙায় আবার কখনও পানিতে বসবাস করে পূর্ব পুরুষের ন্যায় তাদের জীবন অতিবাহিত হচ্ছে। সাধারণত বেদেরা নিরক্ষর হয়ে থাকে। সেখানে ৪ সন্তানের মধ্যে ৩ জনকে মাদরাসা শিক্ষায় সুশিক্ষিত করে ব্যতিক্রমী নজির সৃষ্টি করছেন সর্দার মো. আশরাফ আলী। মুন্সিগঞ্জ জেলার লৌহজং থানার গোয়ালিমন্ডার গ্রামের মো. মোসলেম আলী সর্দারের ছেলে আশরাফ আলী। তিনিও বেদেদের একটি বহরের সরদার। বংশ পরম্পরায় বেদে হিসেবে যাযাবর থেকেই তারা জীবনযাপন করছেন। আশরাফ আলী জানান, জন্ম থেকেই নৌকায় বসবাস করে আসছি। শিক্ষা অর্জন ভাগ্যে জোটেনি। মাত্র ১৮ বছর বয়সেই আরেক বেদের মেয়ে ফরিদা বেগমের সঙ্গে বিয়ে হয়। যেখানে নৌবহর গিয়ে থামে সেখানেই ডাঙায় স্থান নিই আমরা। ওই এলাকা ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে ঘুরে কড়ি, মালা, মাদুলি বিক্রি করি। তিনি বলেন, প্রথম সন্তান আশিক আহমেদের বয়স যখন ৫ বছর হয় তখনই তাকে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। কিন্তু আশিকের অনাগ্রহের কারণে আর সম্ভব হয়নি। এরপর দ্বিতীয় সন্তান মো. আতিকুল ইসলাম পৃথিবীতে আসে। তাকে মাদরাসায় পড়িয়ে কোরআনের হাফেজ বানিয়েছি। সে এখন ঢাকায় যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি কওমি মাদরাসার ছাত্র। এপর তৃতীয় সন্তান হুসাইন আহমেদের জন্ম হয়। তার দুই বছর পরই জন্ম হয় মো. হাসান আহমেদের। আমাদের সঙ্গে থেকেই তারা বড় হতে শুরু করে। প্রত্যেককে ৩য় শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা দিয়ে ঝালকাঠি জেলার রাজাপুর উপজেলার বাইপাস মোড়ে বেলায়েত ক্বারীর মাদরাসায় ভর্তি করে দিই। সেখানে তারা শিক্ষা নিয়ে বর্তমানে পার্শ্ববর্তী পিরোজপুর জেলার ভান্ডারিয়া উপজেলার ধাওয়া কওমি মাদরাসায় কোরআন শিক্ষা নিচ্ছে।
শিক্ষার খরচের বিষয়ে আশরাফ আলী জানান, আমরা গরিব মানুষ। সেভাবে খরচ দিয়ে চালাতে পারি না। যা পারি তা মাদরাসা প্রধানের কাছে দিই। বাকিটা তিনিই ব্যবস্থা করে চালিয়ে নেন। কোরআন শিক্ষা দেয়ার উদ্যোগের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা গরিব হলেও তো মুসলমান। পেশার দিক থেকে আমরা তেমন ধর্ম পালন করতে পারি না। তাই ছেলেদেরকে কুরআন শিক্ষা দিতে শুরু করেছি। মরার পরে যেন ওরা আমাদের জন্য দোয়া করতে পারে। ওরাই এখন আমার আশা-ভরসার স্থল। আশরাফ আলীর সন্তান হুসাইন আহমেদ জানায়, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে কুরআন শেখা শুরু হয় তার। রাজাপুর দারুল উলুম কওমী (বেলায়েত ক্বারীর মাদরাসা নামে খ্যাত) মাদরাসায় প্রথম ছবক নেয় সে। ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে কুরআন দেখে শুদ্ধভাবে পড়া শিক্ষা (ক্বারিয়ানা) সম্পন্ন করে ১ ডিসেম্বর কুরআন মুখস্ত করে (হিফজ) পড়া শুরু হয়। এরপর ভান্ডারিয়া ধাওয়া কওমি মাদরাসায় ভর্তি হলে সেখানে বর্তমানে ৫ম পারার ১৯পৃষ্ঠায় হেফজ পড়ছে সে। গত রমজানে বরগুনা জেলার বামনা লঞ্চঘাট সাহেবের বাড়ি জামে মসজিদে তারাবির নামাজ পড়িয়েছে বলেও জানায় হুসাইন।
আরেক ভাই হাসান আহমেদ জানায়, বড় ভাই যেখানে গিয়ে পড়ে আমিও তার সঙ্গে সঙ্গে থাকি। রাজাপুর দারুল উলুম কওমি মাদরাসায় প্রথম ছবক নিই। বর্তমানে ভান্ডারিয়া ধাওয়া কওমি মাদরাসায় কোরআন দেখে শুদ্ধভাবে (ক্বারিয়ানা) ২৭তম পারায় পড়ছি। কোরআন শিক্ষা নিতে পেরে সন্তোষ প্রকাশ করে তারা জানায়, আমাদের সবাই স্নেহ করে ও ভালোবাসে। ইকোপার্ক সংলগ্ন কিফাইতনগর (পুরাতন ফেরিঘাট) জামে মসজিদে জামায়াতের সঙ্গে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করি। মাঝে মধ্যে ইমাম সাহেব অনুপস্থিত থাকলে এলাকার লোকজন আমাদের নামাজ পড়ানোর জন্য অনুরোধ করেন। আমরাও তাদের অনুরোধে দায়িত্ব পালন করি।
Leave a Reply