কুয়াকাটা প্রতিবেদক ॥ পটুয়াখালী জেলার কলাপাড়া উপজেলা সাগরকন্যা কুয়াকাটায় জমি নিয়ে প্রতারণা পুরানো খবর। একই জমি একাধিক ব্যক্তির কাছে বিক্রি, রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করে জমি দখল, ভূমি অফিসের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে জাল দলিল তৈরি করে যুগের পর যুগ ধরে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে একটি সিন্ডিকেট। এমন প্রতারনা করে অল্পতে আঙ্গুল ফুলে কলা গাছ বনে গেছেন কেউ কেউ। তেমনই একজন কুয়াকাটা ইসলামপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার মাওলানা মোঃ ফারুক মীর।
অভিযোগ রয়েছে জামায়াতের সাথে সম্পৃক্ত থেকে বিএনপির শাসন আমলে বিত্ত-বৈভবে অল্পতেই কোটিপতি বনে গেছেন। আর বর্তমানে ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়া মীর কাশেম আলীর হাতে প্রতিষ্ঠিত ম্যাক্সিম গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সিম হোল্ডিংস প্রাইভেট লিমিটেডের কুয়াকাটায় দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন। যদিও ফারুক মীর দাবি করেছেন, ম্যাক্সিম হোল্ডিংস প্রাইভেট লিমিটেড কেবল মাত্র তাদের কাছ থেকে জমির ক্রেতা। এছাড়া আর কোন সম্পর্ক নেই ওই প্রতিষ্ঠানের সাথে। তবে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নাশকতার একাধিক মামলার এই আসামী কুয়াকাটায় একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছেন। ক্ষমতাশীন আ’লীগে অনুপ্রবেশকারী নেতাদের সাথে সখ্যতা রেখে ভূমিদুস্যতা চালিয়ে আসছেন তিনি।
ইতিমধ্যে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে একাধিক অভিযোগের তদন্ত চলছে। দুর্নীতি দমন কমিশন সূত্র জালিয়েছে, কমপক্ষে দুটি অভিযোগের তদন্ত প্রায় শেষ পর্যায়। যদিও ফারুক মীর দাবি করেছেন, উদ্দেশ্যমূলকভাবে তাকে হয়রানী করার জন্য একটি পক্ষ বিভিন্ন দপ্তরে মিথ্যা অভিযোগ দাখিল করছেন। অনুসন্ধান চালিয়ে দেখা দেছে, কুয়াকাটা ইসলামপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার পদটিও পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত। জানা গেছে, তার দাদা আব্দুর রহমান মীর ওরফে হিম্মত আলী এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠাতা করেন। প্রতিষ্ঠার পরপরই হিম্মত আলীর পুত্র মোসলেম আলীকে ওই মাদ্রাসার সুপারের দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি অবসরে গেলে মাদ্রাসা পরিচালনা পর্ষদের ওপর চাপ সৃষ্টি করে কোন ধরনের ভাইবা এবং পরীক্ষা ছাড়াই ২০১৪ সালে সুপার পদে পদোন্নতী গ্রহণ করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০০ সালে সহকারী মৌলভী পদে পিতার সুপারিশে যোগ দেন ইসলামপুর দাখিল মাদ্রাসায়। মাত্র পাঁচ বছরের ব্যবধানে রাতারাতি তিনি কম্পিউটার পদে পদোন্নতী পান। এরপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। পিতার ক্ষমতাবলে ২০১৪ সালে সুপার পদে আসিন হন।
অভিযোগ রয়েছে ফারুক মীরের থেকেও অভিজ্ঞ এবং যোগ্যতা সম্পন্ন শিক্ষক থাকলেও তারা ক্ষমতার দৌঁড়ে হেরে গিয়ে সুপার হতে পারেনি। মুঠোফোনে কয়েকজন শিক্ষকের সাথে কথা হলে তারা জানান, ইসলামপুর দাখিল মাদ্রাসা সুপার ফারুক মীরের একক সিদ্ধান্তে চলে। ওই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদের মধ্যে কোন সমন্বয় নেই। বিভিন্ন বিল ভাউচার করে সরকারি টাকা উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে এই শিক্ষকের বিরুদ্ধে। এমনকি স্থানীয়ভাবে একটি এতিমখানা প্রতিষ্ঠার কথা বলে বিভিন্ন জনের কাছ থেকে টাকা উত্তোলন করে থাকেন ফারুক মীর। পাশাপাশি মাদ্রাসায় ক্লাশ চলাকালীন সময়ে তিনি মাঝে মাঝে ক্লাশে যান। বাকি সময়ে নিজের দোকান, সীকুইন হোটেল, আলীপুরে দুটি বরফ কল, সানব্রিকস নামের একটি ইট ভাটা দেখাশুনা করে সময় কাটান। এলাকায় সজ্জন হিসেবে পরিচিত ফারুক মীরের জমি সংক্রান্ত একটি প্রতারণার চিত্র প্রকাশ পেলে টক অব দ্যা কুয়াকাটা হয়ে যান এই শিক্ষক। জানা গেছে, জাল দলিল করে একই দাগের সম্পত্তি একটি গ্রুপের কাছে বিক্রি করে হাতিয়ে নিয়েছেন কোটি টাকা। বর্তমানে ওই আবাসন গ্রুপের সাথে একাত্ম হয়ে জমির মূল মালিককে সম্পত্তি থেকে বিতাড়িত করেছেন।
বরগুনার বাসিন্দা জমির মালিক সৈয়দ মোঃ মহিববুল্লাহ জানান, পিতার ক্রয় করে রেখে যাওয়া জমির দখল নিতে গেলে স্থানীয় ক্যাডারদের দিয়ে মারধর করে আমাদেরকে উচ্ছেদ করে দিয়েছে। ফারুক মীরের নির্যাতনে আমাদের জমিতে দখল নিতে পারছি না। অথচ মহামান্য হাইকোর্ট আমাদের রায় দিয়েছেন। এর আগে যতগুলো মামলা তিনি বা আমরা দিয়েছি তার প্রত্যেকটিতে আমাদের পক্ষে রায় দিয়েছে। কিন্তু ফারুক মীর ক্ষমতাশীন হওয়ায় আমরা জমিতে গেলেই মারধর করে তাড়িয়ে দেয়। তিনি জানান, ১৯৪৮ সালের ১৫ নভেম্বর আবদুচ ছালাম আমার পিতা মৃত সৈয়দ ইয়াকুব আলীর কাছে ৫ একর ৪৮ শতাংশ জমি (বাকেরগঞ্জ হালে পটুয়াখালী স্টেশন কলাপাড়া এসআর অফিস খেপুপাড়া তদাধিন জেএল নং ৩৪ লতাচাপলি মৌজা ও কিসমতের অন্তগত আরএস ১২৯ নং খতিয়ানের হাল ৫১৫৮, ৫১৫৯, ৫২২৬, ৫২২৭, ৫২২৯, ৫১৫৮/৫৪৫৪, ৪৮১৪,৫৫৬৭ ও ৫৫৬৮ নং দাগ) থেকে বিক্রয় করেন। এবং সাব কবলা দলিল মূলে আবদুচ ছালাম ওই বছরের ২৫ নভেম্বর বুজিয়ে দেন। সেখান থেকে আমার আব্বা তার ভাই হিম্মত আলীর কাছে এক একর ৭২ শতাংশ বিক্রি করেন। বিক্রির পর এই জমি তারা দখলে নেন। এরপরে ওই জমি থেকে হিম্মত আলী স্থানীয় আলতাফ ও তার ওয়ারিশদের কাছে এক একর ৬৮ শতাংশ বিক্রি করে দখল বুঝিয়ে দেন। এবং ৫ শতাংশ কবরস্থানের জন্য রাখেন। যেহেতু তারা আমাদের আত্মীয় সেকারণে এক শতাংশ বেশি দখল নিলেও আমরা তা ছেড়ে দেই।
সৈয়দ মহিববুল্লাহ জানান, তাদের জমি সব বিক্রি করার পর ওই একই পরিমাণের জমি মীর কাসেম আলীর প্রতিষ্ঠিত ম্যাক্সিম গ্রুপের কাছে বিক্রি করেন। যেহেতু একই দাগে জমি রয়েছে সেকারণে ভুল বুঝিয়ে তাদের জমি বিক্রির পর দ্বিতীয় দফায় একই পরিমাণের জমি ম্যাক্সিম গ্রুপের কাছে বিক্রি করে দেন। সেই সাথে ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে আমাদের অবশিষ্ট জমির মধ্যে থেকে দখল বুঝিয়ে দেন। মূলত তারা ভূমি অফিসের অসাধু কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশ করে সোলে সূত্রে জাল ডিক্রি করে দখলে নেন। ওই জাল ডিক্রির বিরুদ্ধে ২০০৪ সালে মোকদ্দমা করলে ২০১৩ সালে আদালত আমাদের পক্ষে রায় দেন। ওই রায়ের বিপরীতে সৈয়দ ইয়াকুব আলীর ওয়ারিশগণ ২০১৩ সালেই আপিল করেন। দোতরফা শুনানী শেষে আদালত ২০১৪ সালে ওই আপিল খারিজ করে দেন। এ নিয়ে তারা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে সেখানেও আমরা জয়ী হই। কিন্তু এত রায় থাকার পরও আমরা জমি দখলে নিতে পারছি না ফারুক মীরের অবৈধ ক্ষমতার কারণে। যদিও সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ইসলামপুর দাখিল মাদ্রাসার সুপার ফারুক মীর।
তিনি জানিয়েছেন অন্যের কোন জমি আমরা বিক্রি করেনি। জমি দখলের বিষয়ে তিনি স্বীকার করেন, সৈয়দ ইয়াকুব আলীর বংশধরেরা জমি পাবেন। কিন্তু এখানে না। কোন দাগ থেকে জমি পাবেন সেই প্রশ্ন করলে তিনি কোন উত্তর দেননি। সৈয়দ ইয়াকুব আলীর সন্তান মহিববুল্লাহ পৈত্রিক সূত্রে প্রাপ্ত জমিতে গেলে মারধর করেছেন এমন তথ্যের বিষয়ে ফারুক মীর বলেন, আমি মারধর করিনি। মূলত তাদেরকে জমি থেকে বের করে দিয়েছি। তিনি স্বীকার করেন জামায়াতের রাজনীতি নয়, মূলত তিনি যুবদলের সাথে সম্পৃক্ত। মীর কাশেসের ব্যবসা দেখভালের দায়িত্বে তিনি রয়েছেন এমন প্রশ্নের কোন উত্তর দিতে পারেনি তিনি।
স্থানীয়ভাবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ছাত্র অবস্থায় থেকেই শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িয়ে পরেন ফারুক মীর। কুয়াকাটায় তার নিজস্ব ফারুক বাহিনী রয়েছে। তবে যুদ্ধপারাধীদের বিচার শুরু হলে কিছু দিন প্রকাশ্যে থাকলেও পরে আত্মগোপনে চলে যান তিনি। আর মীর কাশেমের ফাঁসি কার্যকরের পর যুবদলের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ফিরে আসেন কুয়াকাটায়। মীর ফারুক স্বীকার করেছেন তার বিরুদ্ধে একাধিক নাশকতার মামলা ছিল। কিন্তু তার সবগুলোতেই তিনি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। একই সাথে তার পুরো পরিবার বর্তমান সরকার বিরোধী রাজনীতিতে সক্রিয়। (চলবে)
Leave a Reply