বাউফল প্রতিনিধি ॥ ষাটোর্ধ্ব গনি গাজীর রিক্সার পেডেলে চলে পাঁচ ছেলে-মেয়ের লেখা পড়ার খরচ। ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করতে অদম্য সে। শুরুতে ঘরসংসারের খাই-খরচ চালাতে পেডেলে পা রাখলেও প্রায় পয়ত্রিশ বছর ধরে রিক্সার প্যাডেল চেপে চলেছেন তিনি কেবল ছেলে-মেয়েদের শিক্ষার আলো দেখাতে। কঠোর পরিশ্রমে উপার্জিত অর্থে পটুয়াখালীর বাউফলের নাজিপুর গ্রামের রিক্সাচালক গনি গাজীর দুই ছেলে এখন ইঞ্জিনিয়ার। এইচএসসি শেষ করে একটি সরকারি কলেজে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স করছেন একমাত্র মেয়ে আর সবার ছোট ছেলেটি পড়াশুনা করছেন এইচএসসিসে। উচ্চ শিক্ষার স্বপ্ন দেখছে এরাও।
বরিশাল সরকারী পলিটেকনিক কলেজ থেকে ডিপ্লোমা শেষে ঢাকার শাহবাগ এলাকার আইইবি (এএমআইইবি) বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ট্রিপলইতে বিএসসি করেছেন পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে সবার বড় গাজী রাসেল। সংসারে অভাবের তাড়নায় একটি বেসরকারি কোম্পানির কাজে যোগদানের পর দ্বিতীয় ছেলে গাজী সোহাগের পড়াশুনা নবম শ্রেণির পর আর না এগুলেও তৃতীয় গাজী কামরুল ইলেকট্রিক্যালে বরিশাল সরকারী পলিটেকনিক কলেজ থেকে ডিপ্লোমা শেষে ঢাকায় অবস্থান করছেন কোন একটি বিশ^বিদ্যালয় থেকে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশুনার জন্য। এরপর মেয়ে গাজী শিরিন পৌর সদরের ইঞ্জিনিয়ার ফারুক তালুকদার মহিলা কলেজ থেকে মানবিকে এইচএসসি পাস করে বাউফল সরকারি কলেজে সমাজ বিজ্ঞান বিষয়ে অনার্স করছেন। সবার ছোট গাজী হৃদয় এইচএসসি করছেন বোনের সঙ্গে একই কলেজে। রিক্সার পেডেল ঘুরিয়ে এই পাঁচ-পাঁচটি ছেলে-মেয়েকে শিক্ষিত করে গনি গাজী দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চলেছেন স্থানীয়দের মাঝে।
পৌরসদর ছেড়ে বিভাগীয় শহর বরিশাল, কখনো আবার বিভাগীয় শহর ছেড়ে পৌর সদরের অলীগলিসহ গ্রামের রাস্তায় রিক্সায় যাত্রি নিয়ে ফিরেছেন গনি গাজী। নিজের সম্পর্কে বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। আবার স্বাভাবিক হয়ে জানান তিনি রিক্সার পেডেল ঘূরিয়ে সংসারের ঘানি টানার মাঝেও তার ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার পেছনের গল্প। গনি গাজী জানান, নিজে শিক্ষিত না হওয়ার কস্ট ভুলতে ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তোলার স্বপ্ন দেখতেন তিনি বিয়ের পর থেকেই। তবে বড় ছেলে রাসেল গাজীর এসএসসি পাসের পরেই তার এই স্বপ্নে এক ভিন্ন মাত্রায় ইতিবাচক ধাক্কা লাগে। বরিশাল পলিটেকনিকে চান্স পাওয়ার পরে বিভাগীয় শহর বরিশালে ছেলে রাসেলের থাকার জন্য মেস কিংবা ছোটখাট ভাড়াবাসা খুঁজে পেতে এক প্রতিবেশির সহোযোগিতা চাইতে গেলে প্রতিবেশি তাকে মেস কিংবা বাসা খুঁজে দেয়ার পরিবর্তে ‘গরীবের ছেলের আবার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন, ঢাকায় গার্মেন্টে কাজে পাঠাও’ বলে তিরস্কার করেন তাকে। এর পরই বড় ছেলে রাসেলকে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশুনাসহ তার ছেলে-মেয়দেরকে শিক্ষিত করার ব্যাপারে প্রতিজ্ঞাবন্ধ হন তিনি। প্রতিজ্ঞানুযায়ি কোন এক বৃহস্পতিবার দিন নিজে গ্রামের বাড়িতে অবস্থানের পাঠ চুকিয়ে ছেলে রাসেলকে লাকড়ি বোঁঝাই ভ্যানের ওপড়ে বসিয়ে পাড়ি জমান তিনি অজানা-অচেনা অবস্থানের উদ্দেশে বিভাগীয় শহর বরিশালে। ওই দিন গ্রামের রাস্তা শেষে পৌর সদর পেড়িয়ে মহাসড়ক ধরে বরিশালে পথে যেতে যেতে ক্লান্তি আর পায়ের ব্যাথায় ভ্যানগাড়ির প্যাডেল যেন চলছিল না তার। পথে দবদবিয়া ফেরিঘাটে গিয়ে কোমরের গামছায় গায়ের ঘাম মুছে সড়কপাশে টং দোকানে কিছুটা বিশ্রাম আর চিতই পিঠা খেয়ে শক্তি ফেরান তিনি ভ্যান চালিয়ে বরিশাল সদরে পৌঁছার। এক রিক্সা ড্রাইভারের সহোযোগিতায় রুপাতলী এলাকায় ইউসুফ কাজি নামে একজনের বাসায় ঠাঁই হয় সন্ধ্যা নামলে। ছেলে গাজী রাসেলকে ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে পর দিন শুক্রবারে কলেজ ঘুরিয়ে দেখান নিজের ভ্যানে চড়িয়ে। প্রায় পনের দিনের মতো নিজের ভ্যানে চড়িয়ে ছেলেকে কলেজে নিয়ে যেতেন তিনি। এরপর সব শুনে ছেলে রাসেলকে কলেজে যাওয়ার জন্য একটি সাইকেল দেন কাজির শশুর বাড়ির লোকজন। দেখতে দেখতে ছেলে রাসেলেরও জুটে যায় প্রাইভেট-টিউশানি। পরিবার নিয়ে তিনিও কিছুদিন পর স্থায়ি হন বরিশাল শহরে। প্রতিকুলতাকে পেছনে ফেলে ছেলে-মেয়েদের শিক্ষিত করতে হতদরিদ্র গনি গাজী অদম্য। নিজের বসত ভিটামিলে ১১ শতক জমি ছাড়া নেই আর কোন জায়গাজমি। নিজে পড়াশুনা না জানলেও দৃঢ় ইচ্ছা শক্তি ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করবেন তিনি। গনি গাজীর সেই ইচ্ছাশক্তি এখন বাস্তবে রূপ নিতে চলেছে।
গনি গাজী জানান, বছর তিনেক আগে গ্রামের বাড়ি চলে এসেছেন। ছেলে গাজী রাসেলও ঢাকায় উঠেছে। বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে ঢাকার শ্যামলী এলাকায় মোহাম্মদিয়া নামে একটি সিসি ক্যামেরা সাপ্লাইয়ার্স ও সার্বিসিং কোম্পানিতে কাজ করছেন। দ্বিতীয় ছেলে গাজী সোহাগ একটি এ্যাম্বুলেন্সের ড্রাইভার। তৃতীয় গাজী কামরুল বরিশাল থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষে ঢাকায় উঠে কোন একটি বিশ^বিদ্যালয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ভর্তি চেস্টার ফাকে একটি ট্রান্সফর্মার কোম্পানির কাজে যোগদান করলেও করোনার কারণে সেই চাকুরি নেই তার। বিশ^বিদ্যালয়ে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির চেস্ট করছে সে। বাকী ছেলেমেয়ে দু’টোকে স্থানীয় পৌরসদরের সরকারি কলেজে আছে। রিক্সা টানার প্রথম দিকের জিনু, অনীল মালাকার, মকবুল, জামাল, আলম, গোমা মতলেব, বারেক চৌকিদার, আলী মোল্লার মতো বন্ধুবান্ধবদের অনেকেই জীবিত নেই। অনেকে আবার পেশা ছেড়েছেন। অটোগাড়ির গতিতে গ্রামের রাস্তাতেও প্যাডেলের রিক্সা এখন অচল প্রায়। ছেলেমেয়েদের লেখাপড়া চিন্তায় ভাড়ায় নিয়ে অটোগাড়ি চালাতে হচ্ছে তাই মাঝে-মধ্যেই। গনি গাজীর বড় ছেলে গাজী রাসেল বাবার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, ‘আমাদের মতো হতদরিদ্র পরিবারের ছেলে-মেয়েদের প্রতিকুলতার পথ পাড়ি দিয়েই বড় হতে হয়। বাবা-মা আমাদের লেখাপড়ার করাতে গিয়ে অনেক সয়ে চলছেন। এখন অন্তত দুই ভাইয়ের সরকারি চাকুরি হলে বাবা-মায়ের অমানবিক কস্টের লাঘব হতো। আমাদেরও অবস্থার পরিবর্তণ আসতো।’
গনি গাজী বলেন, ‘ছেলে-মেয়েরা পড়াল্যাহায় ভালোই আগাইতেছে। অভাবী জীবনে ওদের পড়াল্যাহা করানো ছাড়া কোনই সঞ্চয় করতে পারি নাই। স্ত্রী মিনারা বেগম ঘরে অসুস্থ্য। কোন ধরণের সরকারি-বেসরকারি সাহায্য সহোযোগিতা পাই না। এ্যাহন ওদের ভাল কর্মসংস্থান অইলেই অয়। দরিদ্র এই জীবনে বেশি কিছু পাওয়ার নাই। বড় ছেলেটোর একটা সরকারি চাকুরি হইলে এই অসহায়ের জীবনের সব কস্টগুলো সার্থক অইতে।’ পৌর সদরের ইঞ্জিনিয়ার ফারুক তালুকদার মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক অহিদুজ্জামান সুপন বলেন, ‘নানা প্রতিকুলতা আর অভাব-অনটনের মাঝে গনি গাজী তার ছেলেমেয়েদের উচ্চ শিক্ষিত করে তুলছেন। ছেলেমেয়রা সরকারি চাকুরি পেলে দীর্ঘদিনের কায়ক্লেশ থেকে পরিবারটি মুক্তি পাবে।
Leave a Reply