নুসরাতে আজীজ:
যাঁরা আশা নিয়ে বসে আছেন, দেশ করোনামুক্ত হলে চাকরি খুঁজবেন, চাকরি পাবেন। এখন কোনোমতে দিন চালিয়ে দিলেই চলবে। তাঁরা কি ঠিক ভাবছেন?
কিছু পরিসংখ্যান দিয়ে শুরু করা যাক। আমেরিকায় বেকারের সংখ্যা ৩০ মিলিয়নের ওপরে, কানাডায় ২.৬ মিলিয়ন। ধাৰণা করা হচ্ছে, গ্রেট ব্রিটেনে বেকারত্বের সংখ্যা এই বছর ৩.৫ মিলিয়নে উন্নীত হবে। বেকারত্বের হার বিবেচনায় এই মুহূর্তে আমেরিকায় প্রায় ১২%, কানাডায় প্রায় ১৪%, স্পেনে প্রায় ১৫% লোক বেকার। গড়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নে বেকারত্বের হার ৭%–এর কাছাকাছি। বাংলাদেশিদের জন্য এসব দেশে নিকট ভবিষ্যতে নতুন করে চাকরির সুযোগ তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম।
অন্যদিকে করোনাভাইরাস এবং তেলের মূল্যহ্রাস মধ্যপ্রাচ্যকে মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দায় ফেলে দিয়েছে। সৌদি আরব বলছে, তাদের বেকারত্বের হার প্রায় ১২%, যা প্রকৃতপক্ষে আরও বেশি। মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য দেশের অবস্থাও কমবেশি একই রকম। প্রবাসী বাংলাদেশিদের সংখ্যা তুলনামূলকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে অনেক বেশি। এই দেশগুলোতে বাংলাদেশিরা চাকরি পাওয়ার চেয়ে চাকরি হারাবেন অনেক বেশি। ফলে বাংলাদেশি প্রবাসীদের মধ্যে বেকারত্বের হার বাড়বে।
বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশগুলোর অবস্থাও হতাশাব্যঞ্জক। সেন্টার ফল মনিটরিং দি ইন্ডিয়ান ইকোনমির মতে, ভারতে এখন বেকারত্বের হার ২৭%–এর মতো। সাউথ এশিয়ান জার্নালে বাংলাদেশের ২০ মিলিয়ন লোক চাকরিহারা হওয়ার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। আমি যদি বিশ্বব্যাংকের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারের (২০১৯ সালে প্রবৃদ্ধির হার ৮.২%) সঙ্গে বেকারত্বের হারের (২০১৯ সালে বেকারত্বের হার ৪.২%) একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণ করি এবং ২০২০ সালে বাংলাদেশের প্রবৃদ্ধি (আইএমএফের পূর্বাভাস অনুযায়ী) ২% ধরি, তবে এ বছর বাংলাদেশে বেকারত্বের হার (আনুমানিক) ১৬% বা তার চেয়ে বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আবার প্রবাসীদের কিছু বেকারত্বও এতে যোগ হবে। দেশ–বিদেশে মিলে এত বড় ধরনের বেকারত্ব বাংলাদেশ কীভাবে সামাল দেবে?
প্রশ্ন জাগে, তবে কি করোনা চলে গেলে পৃথিবীটা আগের অবস্থানে ফিরে যাবে? মানুষ আগের মতো সব চাকরি ফেরত পাবে? সরাসরি উত্তরটা না দিয়ে একটু বিশ্লেষণ করা যাক।
প্রথমত, করোনা যেতে অনেক সময় লাগবে। তত দিনের আশায় বসে থাকা বোকামি ছাড়া আর কিছুই নয়। দ্বিতীয়ত, করোনা চলে গেলেও আমরা আগের পৃথিবীটা দেখতে পাব না। দেখব এক ‘নতুন পৃথিবী’! নতুন পৃথিবীতে অনেক কিছুই নতুন, যা আগে আমরা অনেকেই ভাবিনি।
দেখব অনেক কিছুই স্বয়ংক্রিয় আর অনলাইনে চলে গেছে। শুধু আপনি আর আমিই আগের মতো রয়ে গেছি! এই অনলাইন আর স্বয়ংক্রিয়তার যুগে অনেকেই যন্ত্রের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে চাকরি হারাবেন বা পুনরায় চাকরি পাবেন না। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে বড় ধরনের ‘কাঠামোগত বেকারত্বের’ সৃষ্টি হবে।
ড. ইউনূসের একটি লেখা পড়েছিলাম। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে যাতে বাংলাদেশের মানুষ ঢাকায় বসে নিউইয়র্কের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে পারে। তখন ভেবেছি সেটি হয়ে উঠতে অনেক সময় লেগে যাবে। কিন্তু বাস্তবে বেশি সময় লাগেনি। আজ বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কায় বসে অনেক লোক ইংল্যান্ড, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াতে চাকরি করছেন। কাজেই পৃথিবীতে সবকিছুতেই কাঠামোগত পরিবর্তন এসে গেছে। এই নতুন কাঠামোর নতুন পৃথিবীতে টিকে থাকতে হলে আমাদেরকে সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।’
প্রকৃতপক্ষে, করোনা ক্রাইসিস শুরু হবার বহু আগে থেকেই ব্যবসা–বাণিজ্যে, চাকরি–বাকরিতে এই রূপান্তর শুরু হয়ে গিয়েছিল। করোনা সংকট এর গতি অনেক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। এই রূপান্তর ১৯৯০–এর দশকে বা তার ও আগে থেকেই শুরু হয়েছে। মানুষ কবে থেকে অনলাইন ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিক্ষাদীক্ষা শুরু করেছিল, তা আমরা বিবেচনায় নিতে পারি; আমাজনের প্রতিষ্ঠা জুলাই ১৯৯৪, ই–বে সেপ্টেম্বর ১৯৯৫, গুগল সেপ্টেম্বর ১৯৯৮, ফেসবুক ফেব্রুয়ারি ২০০৪, টুইটার মার্চ ২০০৬, ইনস্টাগ্রাম অক্টোবর ২০১০, ইউটিউব ফেব্রুয়ারি ২০০৫, আর জুমের প্রতিষ্ঠা এপ্রিল ২০১১। এই প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিষ্ঠার সময়কাল দেখে বোঝা যাচ্ছে, এগুলোর কোনোটাই করোনা সংকটের সময়ে শুরু হয়নি।
আশার দিক হলো, বাংলাদেশের একটা বিশাল জনগোষ্ঠী (বিশেষ করে তরুণ শ্রেণি) এই নতুন প্রযুক্তিগুলোর সঙ্গে পরিচিত। অনেকে এতে নিজেদের পারদর্শী করে তুলেছে। তাদের অনেকেই জানে, এই সংকটের মুহূর্তটা কীভাবে সামলাতে হবে। আবার বিশাল একটা জনগোষ্ঠী (যাঁদের বয়স ৪০ এর কোঠায় বা তার বেশি) জানেন না, কীভাবে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজেদের খাপ খাওয়াতে হবে। তাঁদের নিয়েই বেশি দুশ্চিন্তা! তাঁরা কীভাবে এই পরিবর্তিত পরিস্থিতি সামাল দেবেন?
একসময় চাকরি বলতে দীর্ঘমেয়াদি চাকরিকে বোঝাত। সময় পাল্টেছে! মানুষ এখন দীর্ঘমেয়াদি চাকরির কথা কমই ভাবে। আজকাল কিন্তু আত্মকর্মসংস্থানে, খণ্ডকালীন চাকরি এবং চুক্তিভিত্তিক চাকরির সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলছে। মজার ব্যাপার হলো, যাঁরা চাকরি খুইয়েছেন এবং যাঁরা চাকরি দিচ্ছেন, তাঁদের অনেকে আজকাল ‘গিগ অর্থনীতির’ (Gig Economy) দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। ‘গিগ অর্থনীতি’ বলতে স্থায়ী কাজের বিপরীতে স্বল্পমেয়াদি চুক্তি বা ফ্রিল্যান্স (freelance) কাজের প্রচলন দ্বারা শ্রমবাজারের অর্থনীতিকে বোঝায়। সেখানে আপনার দক্ষতা, যোগ্যতা আর কঠোর পরিশ্রমের মূল্য অনেক বেশি। তাতে অল্প সময়ে অনেক উপার্জনও করা সম্ভব।
তাই ‘নতুন পৃথিবী’তে আত্মকর্মসংস্থানে (self-employment) বেশি মনোযোগী হতে হবে। যাঁরা চাকরির বাজারে নতুন এসেছেন, তাঁদের শুধু সার্টিফিকেট নয়, দক্ষতা বাড়াতে হবে। যাতে আপনার দক্ষতাই চাকরিদাতাকে উৎসাহিত করে আপনাকে খুঁজে বের করতে। আর আপনার দক্ষতা ও যোগ্যতা যে প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজে লাগবে, আপনাকে তাদের কাছেও পৌঁছাতে হবে। তাদের জানাতে হবে আপনি কিসে পারদর্শী।
যাঁরা চাকরি হারিয়েছেন, তাঁদের ভাবতে হবে, কেন চাকরি হারালেন। সেটি যদি শুধু করোনা সংকটের কারণে হয়, তবে আপনাকে একই রকম প্রতিষ্ঠানে যোগাযোগ অব্যাহত রাখতে হবে—পুনরায় চাকরি পাওয়া পর্যন্ত। আর যদি মনে করেন ‘নতুন পৃথিবীতে’ আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি পাওয়া কঠিন, তবে আপনার ঝুলিতে নতুন কিছু যোগ্যতা ভরতে হবে। তা না হলে চাকরি পাবেন না। উন্নত দেশগুলোতে মানুষ বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন বয়সে ভিন্ন ভিন্ন চাকরি করে। একজন লোক একসঙ্গে একাধিক চাকরি করে। সেটি এখন সময়ের দাবি। উন্নত দেশের মানুষ সেটি পারলে আমরা পারব না কেন?
উল্লিখিত তিন শ্রেণির মানুষকে এখনই পরিকল্পনা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী কাজে নামতে হবে। এটি ভাবলে চলবে না যে করোনা যাক, তবেই চেষ্টা করা যাবে। করোনা–পরবর্তী পৃথিবীটা কিন্তু অনেক অনেক প্রতিযোগিতার এবং কঠিন হবে!
ড. নুসরাতে আজীজ: সহযোগী অধ্যাপক, আলগোমা বিশ্ববিদ্যালয়, অন্টারিও, কানাডা।
Leave a Reply