ড. এ কে আব্দুল মোমেন :
দেশ ও বিশ্বপরিম-লে শেখ হাসিনা আজ গণতন্ত্র, উন্নয়ন, ন্যায়বিচার ও শান্তির প্রতীক। তারই নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বসভায় শক্ত অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। এক সময়ের ক্ষুদ্র অর্থনীতির দেশটি আজ আবির্ভূত হয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য বিমোচন নিশ্চিত করে বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠার দিকে রয়েছে তাঁর নজর। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলাদেশের শাসনভার নিজের কাঁধে নিয়ে যে শান্তি ও প্রগতির রাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাঁর সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনাও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে একই নীতি অনুসরণ করে এগিয়ে চলেছেন সামনে। ‘সবার সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরিতা নয়’ বিশ্বশান্তির পক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই অমোঘ নীতিই এখনো বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র। এই মূলমন্ত্রের ওপর ভর করেই সকল বাধার পাহাড় ডিঙিয়ে দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এদেশের সর্বকালের সফল প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। তার শাসনামলের প্রতিটি পদে পদে রচিত হচ্ছে সফলতার ইতিহাস।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের অবিসংবাদী ভাষণ ‘বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ দলিল’ হিসাবে ইউনেস্কোর ইন্টারন্যাশনাল মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড রেজিস্টারে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর জাতিসংঘের ইউনেস্কো সদর দপ্তরে মহাপরিচালক ইরিনা বোকোভার ঘোষণার মাধ্যমে এটি বাস্তবায়িত হয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অব্যাহত ও ঐকান্তিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় এ স্বীকৃতি। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা আর স্বাধীনতা অর্জনের লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালির গৌরবময় অবদান মানব ইতিহাসে চিরস্থায়ীভাবে ঠাঁই করে নেয় এ স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। বাঙালির এ অর্জন আজ বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্য, যা মানবজাতিকে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা জোগায়, অনুপ্রেরণা, প্রতিবাদ আর প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে মানুষের অধিকার নিশ্চিত করে।
শেখ হাসিনা সরকারের সফল কূটনৈতিক তৎপরতায় ভারতের সঙ্গে দীর্ঘদিনের অমীমাংসিত স্থলসীমানা ও সমুদ্রসীমা শান্তিপূর্ণভাবে মীমাংসা হয়েছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও ভারত স্থলসীমানা চুক্তি ১৯৭৪-এর প্রটোকল স্বাক্ষর এবং ২০১৫ সালে স্থলসীমানা চুক্তির অনুসমর্থন আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুদীর্ঘ প্রচেষ্টারই সুফল। ইনস্ট্রুমেন্ট অব রেটিফিকেশন এবং লেটার অব মোডালিটিস স্বাক্ষরের মাধ্যমে তৎকালীন ১১১টি ভারতের ছিটমহল বাংলাদেশের এবং আমাদের ৫১টি ছিটমহল ভারতের অংশ হয়ে যায়। ছিটমহল বিনিময়ের মাধ্যমে এর আগে নাগরিকত্বহীন ৫০,০০০ এর বেশি মানুষ তাদের দীর্ঘ প্রতীক্ষিত নাগরিকত্ব লাভ করে।
বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশ্নটিকে গুরুত্ব দিয়ে অনুসরণ করছে দেশের পররাষ্ট্রনীতি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনের জন্য সুনির্দিষ্ট ভিশন নির্ধারণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত করার লক্ষ্যে রূপকল্প ২০২১ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্বের কাতারে উন্নীত করার লক্ষ্যে রূপকল্প ২০৪১ ঘোষণা করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। এর আলোকে কার্যকর ও যুগোপযোগী নীতি গ্রহণ ও কার্যক্রম পরিচালনা করছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকারের নীতি ও বাস্তবমুখী পদক্ষেপসমূহ বিদেশি কূটনৈতিক মিশনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরাম, সভা ও সেমিনারে তুলে ধরছে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি অর্জন করেছে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মন্দা থাকা সত্ত্বেও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদারের কারণে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সরকারের দক্ষ নেতৃত্বে বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি আয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্রমবর্ধমান বিনিয়োগ, রপ্তানি ও বিদেশে কর্মসংস্থানের ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়ে চলেছে দিন দিন।
পানি সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং সবার জন্য সুপেয় ও নিরাপদ পানি ও পয়ঃনিষ্কাশন সুবিধা নিশ্চিতকরণ বর্তমান সরকারের অন্যতম অঙ্গীকার। জলবায়ু পরিবর্তন ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে পানির সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। এ বিবেচনায় বৈশ্বিক পরিম-লেও পানি সম্পদ বিষয়ক আলোচনা বিশেষ গুরুত্ব পাচ্ছে। এ সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামের আলোচনায় পানিকে অন্যতম ‘মানবাধিকার’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর মাধ্যমে মানবজাতির অস্তিত্ব সুরক্ষায় পানির অপরিহার্যতার বিষয়টি পুনর্ব্যক্ত হয়েছে। জাতিসংঘের পানিবিষয়ক ‘হাই লেভেল প্যানেল অন ওয়াটার’-এর (এইচএলপিডব্লিউ) একজন সম্মানিত সদস্য হিসেবে মনোনীত হয়েছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরবের বিষয়। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে বিশ^ব্যাপী সবার জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিবিড়ভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ সরকার।
ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান প্রফেসর ক্লাউস শোয়াবের বিশেষ আমন্ত্রণে ২০১৭ সালের ১৭-২০ জানুয়ারি সুইজারল্যান্ডের ডাভোস শহরে বিশ^ অর্থনৈতিক ফোরামের ৪৭তম বার্ষিক সভায় অংশ নেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। ইতিহাসে এটিই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কোনো নির্বাচিত সরকার প্রধান এ সম্মেলনে অংশগ্রহণের জন্য আমন্ত্রিত হন, যা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গৌরব ও মর্যাদার বিষয়। ডাভোস আলোচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা, কর্মক্ষেত্রে সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করা এবং শিল্প কারখানাগুলোতে যথাযথ পরিবেশগত মান বজায় রাখার ক্ষেত্রে তার সরকারের আন্তরিকতা ও গৃহীত পদক্ষেপসমূহের ওপর আলোকপাত করেন। ‘রূপকল্প ২০২১’ এবং ‘রূপকল্প ২০৪১’ সামনে রেখে সরকারের ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ কর্মসূচির কথাও বিশ্বনেতৃবৃন্দের সামনে তুলে ধরেন তিনি। বার্ষিক এ সভা চলাকালে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের দ্য ইনক্লুসিভ গ্রোথ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট রিপোর্ট ২০১৭-এ বলা হয়, উন্নয়নশীল ৭৯টি দেশের মধ্যে সুসম উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান ৩৬। এ ক্ষেত্রে প্রতিবেশী ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে অনেক এগিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ।
শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্ব ও সফল কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে আন্তর্জাতিক আদালতের রায়ের মাধ্যমে ২০১২ সালে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার এবং ২০১৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সমুদ্রসীমা নির্ধারণ সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি হয়। ঐতিহাসিক এই নিষ্পত্তিতে বঙ্গোপসাগরে ১,১৮,৮১৩ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র-এলাকার ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। বিরোধ নিরসনে বিরল এ পদক্ষেপ গ্রহণ এবং শান্তিপূর্ণ সমাধানে উপনীত হওয়ার এ নীতি আন্তর্জাতিক আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিম-লে প্রশংসিত করেছে। এ রায়ের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের জলসীমায় সম্ভাবনাময় সকল সম্পদ আহরণের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে ২০১৮ সালে ভারত ও চীনের সঙ্গে ‘ব্লু ইকোনমি’ এবং ‘মেরিটাইম খাতের মান উন্নয়নে সহযোগিতা’ বিষয়ে দুটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে।
শেখ হাসিনা সরকারের দূরদর্শী কূটনৈতিক তৎপরতায় ইউরোপ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত (ইইউ) বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গতি সঞ্চার হয়েছে। ২০১৪ সালের জুলাই মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে যুক্তরাজ্য সফর করেন। সেখানে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ আস্থা ব্যক্ত করেন। বাংলাদেশের আর্থ সামাজিক উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে অর্জিত সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। বর্তমান সরকার এশীয়, বিশেষত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় অঞ্চলে কূটনৈতিক স¤পর্ক বৃদ্ধির লক্ষ্যে সার্ক, বিমসটেক, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মাঝে কার্যকর সংযোজক বাংলাদেশ-চীন-ভারত-মিয়ানমার অর্থনৈতিক করিডোর (বিসিআইএম-ইসি), বাংলাদেশ-ভুটান-ভারত-নেপাল (বিবিআইএন) প্রভৃতি আঞ্চলিক/উপ-আঞ্চলিক জোট/ফোরামকে গুরুত্ব দিচ্ছে। এর আওতায় বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধি, নিবিড় যোগাযোগ ব্যবস্থা, জ্বালানি সহযোগিতা বৃদ্ধি, সন্ত্রাসবাদ ও জঙ্গিবাদ দমনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সক্রিয়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে গৃহীত বেশ কিছু কার্যকর পদক্ষেপের অন্যতম সফল পদক্ষেপ হচ্ছে ঢাকায় বে অব বেঙ্গল ইনিশিয়েটিভ ফর মাল্টি সেক্টরাল টেকনিক্যাল অ্যান্ড ইকোনমিক কোঅপারেশন-এর (বিমসটেক) স্থায়ী সচিবালয় স্থাপন। বিমসটেক সচিবালয় বাংলাদেশে কোনো আঞ্চলিক সংস্থার প্রথম সদর দপ্তর। ঢাকায় বিমসটেক সচিবালয়ের সফল প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় কূটনৈতিক সাফল্য।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বিষয়ে তার দূরদর্শী নেতৃত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতিও পেয়েছেন ব্যাপকভাবে। ভূষিত হয়েছেন অজস্র আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননায়। আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০১৮ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বের ৩০তম ক্ষমতাশালী নারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। ২০১৪ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দক্ষিণ-দক্ষিণ সহযোগিতা সম্পর্কিত ‘ভিশনারি অ্যাওয়ার্ড’ এবং ইউনেস্কোর ‘শান্তিবৃক্ষ’ পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৫ সালে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে বাংলাদেশকে মর্যাদাপূর্ণ ‘উইমেন ইন পার্লামেন্ট (ডব্লিউআইপি) গ্লোবাল ফোরাম অ্যাওয়ার্ড ২০১৫’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। ২০১৬ সালে ইউএন-উইমেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘প্ল্যানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন’ হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। জাতিসংঘের একই অধিবেশনে নারীসমাজকে উন্নয়নের মূলধারায় সম্পৃক্ত করে বিচক্ষণ নেতৃত্বদানের স্বীকৃতিস্বরূপ গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফোরাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘এজেন্ট অব চেঞ্জ’ শীর্ষক সম্মানজনক পুরস্কারে ভূষিত করে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা এবং ইউএন পিস বিল্ডিং কমিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা বিশ্বে বিপুলভাবে প্রশংসিত।
২০১৫ এ জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতৃত্বের স্বীকৃতি হিসাবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জাতিসংঘের পরিবেশ বিষয়ক সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘চ্যাম্পিয়নস অব দ্য আর্থ’ পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। একই অধিবেশনে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (আইটিইউ) মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ‘আইসিটিজ ইন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করে। ২০১৬ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭১তম অধিবেশনে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ‘আইসিটি ফর ডেভেলপমেন্ট’ পুরস্কারে ভূষিত হন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়। স্বাস্থ্য খাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা প্রদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড ২০১১-এ ভূষিত হন। একই বছরে, ইউনেস্কো সদর দপ্তরে নারীর ক্ষমতায়ন বিষয়ে বক্তব্য প্রদানকালে গণতন্ত্র সুসংহতকরণ ও নারীর ক্ষমতায়নে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ডাফিন ইউনিভার্সিটি গোল্ড মেডাল ২০১১-এ ভূষিত হন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১১ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের স্কেলিং আপ নিউট্রিশন (এসইউএন) মুভমেন্টের শীর্ষ সাত নেতৃত্বের অন্তর্ভুক্ত হন। ২০১২ সালে জাতিসংঘ মহাসচিবের শীর্ষনেতাদের লিড গ্রুপে অন্তর্ভুক্ত হন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী ২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর সাউথ-সাউথ কোঅপারেশনের পুরস্কার গ্রহণ অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং দারিদ্র্য বিমোচনে বর্তমান সরকারের অসামান্য সাফল্যের জন্য অ্যাচিভমেন্ট ইন ফাইটিং পোভার্টি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হন। খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের কারণে ২০১৩ সালে বিশ্ব খাদ্য ও কৃষি সংস্থার এফএও ডিপ্লোমা অ্যাওয়ার্ড, ইন্দিরা গান্ধী শান্তি পদক এবং ব্রিটিশ পার্লামেন্টের গ্লোবাল ডাইভার্সিটি অ্যাওয়ার্ড ২০১১ লাভ করেন। এগুলো ছাড়াও আরও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা তিনি লাভ করেছেন। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, ট্রি অব পিস অ্যাওয়ার্ড, কালচারাল ডাইভারসিটি মেডাল ২০১২, গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড ২০১৮, অ্যাওয়ার্ড ফর হিউম্যানিটারিয়ান লিডারশিপ ফ্রম গ্লোবাল হোপ কোয়ালিশন ২০১৮ এবং অনন্য নেতৃত্বের জন্য ২০১৮ সালে ইন্টার প্রেস সার্ভিস থেকে পাওয়া আইপিএস ইন্টারন্যাশনাল অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এদেশের মানুষের আশা আকাক্সক্ষার শেষ ভরসাস্থল। এদেশের উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির রূপকার তিনি। তার যোগ্য নেতৃত্বে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি আজ ধ্রুব তারার মতোই উজ্জ্বল। তার নেতৃত্বেই একদিন উন্নতির চরম শিখরে পৌঁছে যাচ্ছে আমাদের এই প্রিয় দেশটি। দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিম-লেও ন্যায় ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় সোচ্চার শেখ হাসিনা। মানবকল্যাণ, টেকসই উন্নয়ন এবং সকল জাতিসত্তার অব্যাহত উন্নয়ন ও মুক্তি বিষয়ে জাতিসংঘে বেশ কিছু প্রস্তাব গৃহীত হয়। এগুলোর বেশ কিছু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদানে। যেমন, তারই নেতৃত্বে ও তারই আনীত প্রস্তাবের কারণে জাতিসংঘে আজ ‘উন্নয়নের অধিকার’ একটি মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। বাংলাদেশের সভাপতিত্বে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে ১৩২৫ নম্বর প্রস্তাবের কল্যাণে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা ও শান্তি বিনির্মাণের প্রতিটি পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়েছে। বাংলাদেশের নেতা শেখ হাসিনার কল্যাণেই আজ জাতিসংঘে শান্তির সংস্কৃতি বা ঈঁষঃঁৎব ড়ভ চবধপব চালু হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী জোরালোভাবে অনুসৃত হচ্ছে।
শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বে ২০১২ অটিজম ও প্রতিবন্ধী শিশুদের অধিকার সংক্রান্ত, আর দ্বিতীয়টি জনগণের ক্ষমতায়ন সংক্রান্ত দুটি বিল জাতিসংঘে পাস হয়। সৃজনশীলতা, উদ্ভাবনীশক্তি, সক্ষমতা এবং কার্যকারিতার সঙ্গে মানুষ কাজ করতে পারলেই কেবল ক্ষমতায়নের সংজ্ঞা সফল হয়। শেখ হাসিনার ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’ তত্ত্বটি ২০১২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরোতে অনুষ্ঠিত ‘রিও+২০ বিশ্ব সম্মেলনে’ ‘যেমন ভবিষৎ চাই’ শীর্ষক দলিল হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁর গতিশীল নেতৃত্বে জাতিসংঘে বাংলাদেশ কর্তৃক উত্থাপিত প্রতিটি বিষয়ই এসডিজির ১৭টি লক্ষ্য এবং ১৬৯টি উদ্দেশ্যের মাঝে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
শেখ হাসিনার শাসনের প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) ভারতের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ গঙ্গা নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে সক্ষম হয় বাংলাদেশ। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর ঐতিহাসিক ঘটনা; যার মধ্য দিয়ে শেখ হাসিনা দীর্ঘমেয়াদি সংঘাতের অবসান ঘটান। সম্প্রতি কূটনৈতিক আলাপ-আলোচনা, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা ও প্রশাসনিক কর্মযজ্ঞের মধ্য দিয়ে ভারতের সঙ্গে অর্ধশতক ধরে ঝুলে থাকা ‘ছিটমহল সমস্যার’ সমাধান করেছেন ৭২ বছর আগে ‘সীমান্ত নির্ধারণ চুক্তি’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে। ফলে গণতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক অধিকার এবং ন্যায়বিচার পেয়েছে দীর্ঘদিন ভাগ্যবিড়ম্বিত থাকা উভয় দেশের ছিটমহলবাসী।
জাতিসংঘের সেকেন্ড কমিটির চেয়ার হিসেবে অধিকাংশ বিতর্কেই বাংলাদেশ সকল সদস্যকে মতৈক্যে নিয়ে আসতে পেরেছে। পিস বিল্ডিং কমিটি (পিবিসি) বা অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিষদের (ইসিওএসওসি) চেয়ার হিসেবে বিশ্বব্যাংকে জাতিসংঘ কমিটিসমূহের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করাতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ।
সাউথ-সাউথ কো-অপারেশনের চেয়ার হিসেবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের ক্ষেত্রে বাধাসমূহ ও করণীয় চিহ্নিতকরণে বাংলাদেশ নেতৃস্থানীয় ভূমিকা গ্রহণ করে। জাতিসংঘের ব্যুরো সদস্য এবং এলডিসি গ্রুপের চেয়ার হিসেবে ইস্তাম্বুল কর্মপরিকল্পনা (আইপিএও) প্রণয়নে বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা রাখে; শুধু তাই নয়, জাতিসংঘের বিভিন্ন ফান্ড যেমন ইউনিসেফ, ইউএনডিপি, ইউএন উইমেন, জাতিসংঘ জনসংখ্যা কমিশন ইত্যাদির চেয়ার হিসেবে ওইসব অঙ্গ সংগঠনের কর্মপরিকল্পনায় ইস্তাম্বুল কর্মপরিকল্পনা অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্যতম ভূমিকা পালন করে।
সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতিসংঘ কমিটির ফ্যাসিলিটেটর হিসেবে ২০১০ সালে বাংলাদেশ উক্ত কমিটির প্রস্তাব সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মতৈক্যের অর্জনে সফল হয়। ‘মানবপাচার প্রতিরোধ সংক্রান্ত জাতিসংঘের বন্ধু’ রাষ্ট্রসমূহের সদস্য হিসেবে জাতিসংঘের প্রস্তাব পাসের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। মানবপাচার প্রতিরোধ ও অবসানের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে উটের জকি ও দাস হিসেবে শিশুদের ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিশ^ নেতৃবৃন্দের মাঝে সোচ্চার জনমত গড়ে তোলেন এবং মধ্যপ্রাচ্যে পাচার হয়ে যাওয়া বাংলাদেশী শিশুদের উদ্ধারের নির্দেশ দেন ও তাদের উদ্ধার পরবর্তী পুনর্বাসনের পদক্ষেপ সংক্রান্ত সার্ক সম্মেলনে ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে জাতিসংঘের ‘ফ্রেন্ডস অব মিডিয়েশন’ ‘ফ্রেন্ডস অব ইনঅ্যালিনেবল রাইটস অব প্যালেস্টাইন’, ‘ফ্রেন্ডস অব নো ফুড ওয়েস্ট, নো ফুড লস’ ইত্যাদি ভূমিকায় মানবতার মর্যাদা রক্ষা এবং জাতিসংঘ সনদের লক্ষ্য অর্জনের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
জাতিসংঘের ‘হি অ্যান্ড শী’ চ্যাম্পিয়ন হিসেবেও বাংলাদেশের নাম চলে আসে সবার আগে। জাতিসংঘ মহাসচিবের ‘শিক্ষাই সর্বাগ্র’ শীর্ষক প্রকল্পে এবং মহাসচিবের স্বাস্থ্যরক্ষা সংক্রান্ত উদ্যোগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে গণ্য করা হয়।
‘জলবায়ু ঝুঁকি ফোরাম (সিভিএফ)’ এবং ‘জলবায়ু ঝুঁকি প্রবণতা তদারকি (সিভিএম)’ গঠন করেছেন তিনিই। তার প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়েই ‘জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বিষয়ক দায়িত্ববিষয়ক রাষ্ট্রদূত ফোরাম’ (অসনধংংধফড়ৎং রিঃয জবংঢ়ড়হংরনরষরঃু ঃড় ঈষরসধঃব ঈযধহমব- অজঈ) এবং ‘জলবায়ু পরিবর্তনের বন্ধ’ু (ঋৎরবহফং ড়ভ পষরসধঃব পযধহমব- ঋঈঈ) গঠন করা হয়েছে, যারা জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধ ঘোষণার পরই আমরা দেখতে পাই যে, অন্যান্য বিশ^ নেতৃবৃন্দ এই জটিল ইস্যুতে এগিয়ে আসছেন।
বৈশি^ক মহামারী করোনাকালে বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপ জাতিসংঘ (টঘ), বিশ^ অর্থনৈতিক ফোরাম (ডঊঋ), বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থা (ডঐঙ), যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সাময়িকী ফোর্বসসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশংসিত হয়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষা থেকে শুরু করে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে তিনি নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন এবং করোনা মহামারির বিস্তার নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়েছে। একই সঙ্গে দরিদ্র মানুষকে ত্রাণ সহযোগিতার পাশাপাশি জীবিকা ও অর্থনীতি বাঁচাতে নিয়েছেন কার্যকরী পদক্ষেপ। দেশের অর্থনৈতিক গতিশীলতা ধরে রাখতে কৃষি ও শিল্পসহ অর্থনৈতিক খাতগুলোতে সময়োপযোগী প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন, যা বিশ^ অর্থনীতিতে একটি রোল মডেল হিসেবে পরিগণিত হয়। যার কারণে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে বলে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘ সনদের এসব মূলনীতির আলোকে একটি সুন্দর, নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ পৃথিবী গড়ার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন। জন্মদিনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা। তাঁর জয়যাত্রা, তাঁর সফলতা অব্যাহত থাকুক। জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
Leave a Reply