আবু আহমেদ: দেশে ইসলামী বন্ড ‘সুকুক’ চালু করার প্রক্রিয়া শুরু করেছে সরকার। সাম্প্রতিক সময়ে এ নিয়ে দেশে সেমিনার ও লেখালেখি হচ্ছে। এ নিয়ে আলাপ-আলোচনা এবং দেশে ইসলামী ব্যাংকিংয়ের প্রসার থেকে একটি বিষয় সহজেই অনুমেয়, দেশে সুকুকের অনেক চাহিদা রয়েছে। যেহেতু বাজেটের ঘাটতি পূরণে বিকল্প উৎস থেকে সরকারের বিপুল অর্থ প্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে এবং দেশে চাহিদাও রয়েছে, তাই সুকুক প্রবর্তনের প্রক্রিয়াটি জোরদার করা উচিত। প্রক্রিয়াটির গতি বাড়াতে কী কী করা যেতে পারে সেদিকে নজর দেওয়া উচিত।
সুকুক হলো সুদবিহীন বন্ড বা ঋণপত্র। সাধারণ বন্ডের মতো এর কোনো নির্ধারিত সুদ নেই। সহজ কথায় বিনিয়োগকারীরা সুকুক থেকে সুদ পাবে না, মুনাফা পাবে। তবে এই মুনাফা হবে ভেরিয়েবল, যা কম বা বেশি হতে পারে। সাধারণত সুকুক চালু করা হয় সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের অধীনে। যে প্রকল্প আয়ের ব্যবস্থা (ইনকাম জেনারেট) করবে, সে ধরনের প্রকল্পে অর্থায়ন করার জন্য সুকুক ইস্যু করা হয়। যেমন—একটি বড় সেতু প্রকল্প হতে পারে। এর ওপর দিয়ে কী পরিমাণ গাড়ি যাবে, মালপত্র পরিবহন করা হবে এবং টোল আদায় করা হবে, তত্ত্বাবধান ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচ কেমন হবে—এসব হিসাব-নিকাশের ভিত্তিতে সুকুক ছাড়া হবে। এ জন্যই সুকুক হোল্ডারের মুনাফা কমবেশি হতে পারে। মূলকথা হচ্ছে, সুকুক ইস্যু করা হয় প্রকল্পকে ভিত্তি করে। এ ক্ষেত্রে বড় প্রকল্পের পাশাপাশি কয়েকটি মাঝারি বা ছোট প্রকল্প মিলিয়েও সুকুক ইস্যু করা যেতে পারে। এর ফেসভ্যালু সরকার নির্ধারণ করবে।
দেশের সাধারণ জনগণের বড় একটা অংশ সুদের বাইরে থাকতে চায়। দেশে তো এখন প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ব্যাংকিং ব্যবসাই শরিয়াহভিত্তিক। আবার সাধারণ ব্যাংকগুলোও শরিয়াহ বিভাগ বা শরিয়াহ শাখা চালু করেছে। বাংলাদেশে বিদেশি ব্যাংকগুলোর মধ্যেও স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকিং চালু করেছে। আমাদের সোনালী, রূপালী বা অগ্রণী ব্যাংকও ইসলামী ব্যাংকিংয়ের বিভাগ চালু করছে। সব কিছু মিলিয়ে এটি স্পষ্ট যে দেশে ইসলামী ব্যাংকিং যথেষ্ট প্রসার লাভ করেছে; যদিও এখানে একটি ঘাটতিও রয়েছে। তা হচ্ছে দেশে এখনো কম্প্রিহেনসিভ ইসলামী ব্যাংকিং অ্যাক্ট প্রণয়ন করা হয়নি। কখনো কখনো পরিপত্র, বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু নির্দেশনা বা রেগুলেটরি আদেশ দিয়ে ইসলামী ব্যাংকিং চলছে। এরই মধ্যে অনেকে, বিশেষ করে ইসলামী ব্যাংকিংয়ে জড়িত লোকজন বলছে, দেশে যেন একটি কম্প্রিহেনসিভ ইসলামী ব্যাংকিং আইন প্রণয়ন করা হয়, যা অন্যান্য দেশে আছে।
বাংলাদেশে দেরিতে সুকুক চালুর উদ্যোগ নেওয়ার সুবিধাটি হচ্ছে অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতা জানা যাবে। এ ছাড়া বিশ্বের অনেক দেশে সুকুক জনপ্রিয়তা পাওয়ায় বাংলাদেশে এর চাহিদা সম্পর্কেও সহজে অনুমান করা যায়। এরই মধ্যে সুকুক চালু করে অনেক দেশ ভালো ফল পাচ্ছে। এমনকি অনেক অমুসলিম দেশও সুকুক চালু করেছে। কারণ তাদের মুসলিম সিটিজেনদের একটি অংশ এটি চায় বলে তারা এটিকে গুরুত্ব দিয়েছে। বাংলাদেশেও অনেক লোক আছে, যারা সুদের ভিত্তিতে বন্ড কিনতে রাজি নয়। দেশে এমনও লোক আছে, যারা সুদের ভিত্তিতে এফডিআরে টাকা রাখতেও রাজি নয়। তাই যেহেতু দেশের জনগণের বিরাট অংশের চাহিদা আছে, সেটিকে পূরণ করা উচিত। সরকারেরও সুবিধা হবে। তার প্রকল্পের অর্থায়নের গতি বাড়বে। এখন সরকারের ট্রেজারি বন্ড রয়েছে। কিন্তু সুকুক ছাড়া হলে সরকার সহজেই প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে পারবে। তখন আর ট্রেজারি বন্ডের দরকার হবে না। এটি সাধারণ মানুষ যেমন ক্রয় করতে পারবে, তেমনি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও নিতে পারবে। অমুসলিম যারা, তাদের জন্যও এতে কোনো বাধা থাকবে না। কারণ এটি সুদ হবে না, এই যা।
আন্তর্জাতিকভাবে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, তুরস্ক, ইরান, কুয়েত, আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, মিসর, নাইজেরিয়া, সোমালিয়াসহ বহু মুসলিম দেশ সুকুক চালু করেছে। অমুসলিম দেশ যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, হংকংসহ কয়েকটি দেশে চালু হয়েছে। সুকুকের শরিয়াহভিত্তিক মুনাফা বণ্টন নিয়ে বিভিন্ন দেশে প্রশ্ন রয়েছে। তবে সব দেশেই এর সুফল পাওয়া যাচ্ছে। সুকুকের সুফলের দিক থেকে মালয়েশিয়া অন্যতম শীর্ষ দেশ। বাংলাদেশে এর যে চাহিদা অনুমান করা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রে আমরাও খুব দ্রুত সুফল পাব বলে আশা করছি। তবে দেশে সুকুক চালুর পাশাপাশি এর নীতিমালাও জরুরি ভিত্তিতে প্রণয়ন করতে হবে।
দেশে সুকুক চালু করার পর ইচ্ছা করলে তা স্টক মার্কেটেও অন্তর্ভুক্ত হতে পারবে। ওখানে সেকেন্ডারি মার্কেটে সুকুক বেচাকেনা হতে পারে; যদিও এর দাম হয়তো ওঠানামা করবে। তবে তা নির্ভর করছে অর্থনীতিতে এর প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান, নির্দিষ্ট প্রকল্পের আয় কত, গড় স্টকহোল্ডার কত পাচ্ছে—এসবের ওপর ভিত্তি করে দাম ওঠানামা করবে। সুতরাং সুকুক স্টক মার্কেটের জন্য ভালো কাজ দেবে।
সুকুক এক প্রকার ইসলামী অর্থায়নের হাতিয়ার। ধারণাগতভাবে এ নিয়ে লেখালেখি করেছেন পণ্ডিত ব্যক্তিরা। মুসলিম ও নন-মুসলিম সব ধরনের বিশেষজ্ঞই সুকুক নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করছেন। সম্প্রতি প্রবাসী বাংলাদেশি গবেষকরাও এ নিয়ে লেখালেখি করছেন, সভা-সেমিনারে বক্তব্য দিচ্ছেন। সবার কাছ থেকেই দেশে সুকুক চালুর পক্ষে বক্তব্য আসছে। এখন বাংলাদেশ সরকার যেহেতু এরই মধ্যে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে, তা যেন বাস্তবের মুখ দেখে, এ জন্য দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সরকারের অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংকগুলোর বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়ারও সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এখন প্রথম কাজ হবে পরামর্শটি যেন দ্রুত নেওয়া হয়। একই সঙ্গে বিদেশি বিষেশজ্ঞদের সহায়তাও নেওয়া যেতে পারে। কিংবা এসংক্রান্ত কমিটি বা সেল বিদেশে গিয়ে এর প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে জেনে আসতে পারে। এ জন্য বিশ্বব্যাংকেরও সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে।
দেড় বছর আগে বাংলাদেশ সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন সুকুক চালুর একটি উদ্যোগ নিয়েছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা যায়নি। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ বিভাগ যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনকেও যুুক্ত করা যেতে পারে। উদ্যোগটি মূলত এগিয়ে নিতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়কেই। সরকারের শুরুর প্রক্রিয়াটি যেন গতি পায় এ জন্য একটি সেল প্রতিষ্ঠা করা যেতে পারে। সেটি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনেই হোক কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীনে হোক। পরে ওই সেল ঠিক করে দিতে পারবে কিভাবে কী করা হবে, ফেসভ্যালু কত হবে ইত্যাদি। এ জন্য আইনের কাভারেজও লাগবে।
মোটকথা হচ্ছে, দেশে সুকুকের চাহিদা যখন আছে, তখন এর সরবরাহও শুরু করতে হবে সরকারকে। এটি প্রাইভেট সেক্টরও চালু করতে পারে, যা বিশ্বের অনেক দেশে আছে। তবে এর আগে প্রাইভেট সেক্টরকে মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। কারণ অনেক করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ওপর মানুষের আস্থার অভাব আছে। তাই শুরুটা সরকারকেই করতে হবে। সরকার যদি একবার এ স্বাদ পেয়ে যায়, আমার কাছে মনে হয় এটি বিরাট একটি উৎস হয়ে দাঁড়াবে সরকারি অর্থায়নের জন্য। আরেকটি বিষয় হচ্ছে, সুকুক নানা ধরনের হয়ে থাকে। তাই আমরা কী ধরনের সুকুক চালু করব, বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তা ঠিক করতে হবে। এ জন্য দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞদের কাজে লাগাতে হবে। কাগজে দেখেছি, সরকার আগে সুকুক চালু করতে চায়, পরে নীতিমালা করবে। কিন্তু বিশৃঙ্খলা এড়াতে নীতিমালা আগে করা দরকার।
লেখক : অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
অনুলিখন : আফছার আহমেদ
Leave a Reply