দেশে প্রথমবারের মতো করোনা শনাক্ত হওয়ার প্রায় সাড়ে তিন মাস পর করোনা পরীক্ষার জন্য সরকার ফি নির্ধারণ করেছে। এত দিন সরকারিভাবে করোনাভাইরাস শনাক্তকরণ পরীক্ষা বিনা মূল্যে হওয়ায় সরকার মনে করছে, অধিকাংশ মানুষ অপ্রয়োজনে এই পরীক্ষা করিয়েছে। কোনো উপসর্গ না থাকলেও পরীক্ষা করিয়েছে। সরকারের এই মনে করার সঙ্গে বাস্তবতার যে কত ফারাক, তা গত কয়েক মাসের পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতার ছবিগুলোই বলে দেয়। পাতা ওলটানোর প্রয়োজন হয় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইনে রোদে পুড়ে অপেক্ষা করতে করতে পরীক্ষা করাতে না পেরে যে অসুস্থ বৃদ্ধ শাহবাগের রাস্তায় মরে পড়ে ছিলেন, তাঁর কথা এত দিনে অনেকেই হয়তো ভুলে গেছেন। কিন্তু মুগদা, শাহবাগ, মহাখালীর ফুটপাতে রাতের বেলাতেও নারী-পুরুষনির্বিশেষে অসুস্থ মানুষের দীর্ঘ সারিতে অপেক্ষার কষ্টকর অভিজ্ঞতা যাঁদের হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, তাঁদের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের আমলাদের এই বক্তব্য কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
উপসর্গ নেই কিন্তু তারপরও পরীক্ষা করিয়েছেন—এমন ব্যক্তি অবশ্য একেবারে যে নেই, তা নয়। আর এই তালিকায় সবার আগে মনে পড়ছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের কথা। তিনি ২৯ মার্চ জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের নিয়মিত সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করানোর কথা জানিয়েছিলেন। সে সময়ে দেশে করোনা শনাক্তকরণের পরীক্ষার ক্ষেত্রে প্রচণ্ড রকম কার্পণ্য করা হচ্ছিল। পরীক্ষার জন্য কিটের মজুত যথেষ্ট না থাকার কারণেই তখন অত্যন্ত সীমিত আকারে পরীক্ষা চালানো হচ্ছিল। প্রধানমন্ত্রী ২৫ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে জানিয়েছিলেন, ১৩ হাজার কিট মজুত আছে এবং আরও ৩০ হাজার আমদানি করা হচ্ছে। তখন পর্যন্ত দেশে পরীক্ষার সংখ্যা মাত্র হাজারখানেক। এমনকি সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা চিকিৎসক এবং অন্যান্য চিকিৎসাসেবীও সে সময়ে পরীক্ষায় অগ্রাধিকার পাচ্ছিলেন না, যেমনটি অন্যান্য দেশে দেখা গেছে।
এরপর উপসর্গ না থাকলেও অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে যাঁদের পরীক্ষা হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আছেন বাজেট অধিবেশনের জন্য সংসদ অধিবেশনে যেসব সাংসদ যোগ দিয়েছেন, তাঁরা। অধিবেশনের জন্য সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও একইভাবে পরীক্ষা করানো হয়েছে। আমরাও মনে করি, তাঁদের এই পরীক্ষাগুলো অত্যাবশ্যক ছিল। তাঁরা ভিআইপি বলে তাঁদের এই পরীক্ষা প্রয়োজন ছিল, ব্যাপারটা তা নয়; বরং রোগটা এসিম্পটোম্যাটিক বা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই উপসর্গ ছাড়াই ছড়ায় বলেই এটি অত্যাবশ্যক ছিল। এই পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি যাঁর পরীক্ষা হচ্ছে তাঁর জন্য যতটা, তার চেয়েও বেশি তাঁর সংস্পর্শে আসতে পারেন এমন অন্য সবার নিরাপত্তার জন্য। কারণ, অন্য যাঁরা সংস্পর্শে আসবেন, তাঁদের মধ্যে কারও স্বাস্থ্যগত অন্য সমস্যা থাকলে যেমন হৃদ্রোগ, ডায়াবেটিস, ক্যানসার কিংবা শ্বাসজনিত রোগ—সেই ব্যক্তির আক্রান্ত হওয়ার এবং মৃত্যুর ঝুঁকি বাড়বে।
উপসর্গ ছাড়াই পরীক্ষা করানোর বিষয়টিকে তাই ঠুনকো অজুহাত ছাড়া অন্য কিছু হিসেবে মেনে নেওয়ার অন্তত বৈজ্ঞানিক কোনো কারণ নেই। বিশ্বজুড়েই কিটের সংকট চলছে, সেই তথ্য কেউই অস্বীকার করবে না। কিট ছাড়াও পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় পিসিআর মেশিন এবং রিএজেন্টের ঘাটতির কথাও নানাভাবে আলোচিত হয়েছে। কিট ব্যবহারের প্রশিক্ষণের অভাবে দক্ষ টেকনিশিয়ানের সংকটের কথাও অজানা নয়। প্রশ্ন হচ্ছে, এসব ঘাটতির কারণেই যদি পরীক্ষার জন্য উপসর্গ থাকতেই হবে এমন শর্ত আরোপ করা হয়, তাহলে তা কি গ্রহণযোগ্য হবে না? আমাদের বিশ্বাস, সেটা অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য হবে।
কিন্তু পরীক্ষা করানো নিরুৎসাহিত করতে ফি আরোপের কৌশল গ্রহণ কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এমনিতেই যথেষ্ট পরিমাণে প্রতিবন্ধক তৈরি হয়ে আছে। বেসরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানে পরীক্ষার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, সেগুলো অধিকাংশেরই সামর্থ্যের বাইরে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে মান নিয়ন্ত্রণের বিষয়টিও যে প্রশ্নসাপেক্ষ, তা জেকেজি নামক এক ভুঁইফোড় প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার ঘটনায় প্রমাণিত। সরকারি হাসপাতাল ও ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার জন্য ভোগান্তির কথা তো শুরুতেই বলেছি।
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত যাঁরা হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন, ১০ দিন কোনো উপসর্গ না থাকলে তাঁদের আর কোনো পরীক্ষা না করে ছাড়পত্র দেওয়ার সিদ্ধান্তও ইঙ্গিত দেয়, আসল সমস্যা হচ্ছে হয় কিটের স্বল্পতা, নয়তো পরীক্ষার সংখ্যা বাড়ানোর জন্য যথেষ্ট সরঞ্জাম এবং সামগ্রী না থাকা। নিন্দুকেরা অবশ্য কানাকানি করেন যে সরকারিভাবে সংক্রমণের সংখ্যা কম দেখিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আছে এমন দাবি প্রতিষ্ঠার জন্যই পরীক্ষা কমানো হচ্ছে। যত কম পরীক্ষা তত কম আক্রান্ত—এই তত্ত্ব তো প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের কল্যাণে এখন বিশ্বের সবাই জানেন।
ওয়াশিংটন পোস্টে ২৭ জুন বাংলাদেশের চট্টগ্রামের ফটোসাংবাদিক শাহনেওয়াজ খানের করোনাকালীন জীবনযাপনের কয়েকটি ছবি ও বর্ণনা ছাপা হয়েছে। শাহনেওয়াজ তাঁর স্ত্রী, তিন সন্তান এবং মায়ের একান্ত ব্যক্তিগত ছবি প্রকাশের সাহস দেখিয়েছেন। তাঁর ২২ মাসের শিশুর ফ্লুর উপসর্গ সত্ত্বেও তিনি কেন তাকে হাসপাতালে নেননি, তার কারণ ব্যাখ্যা করেছেন। চিকিৎসাব্যবস্থার করুণ চিত্র এবং করোনা মোকাবিলায় সরকারের প্রস্তুতিহীনতার আসল রূপ তাঁর পারিবারিক ছবিগুলোতে উঠে এসেছে। হাসপাতালে না গিয়ে তাঁরা যে ঝুঁকি নিতে বাধ্য হয়েছেন, সে রকম ঝুঁকি আরও কতশত বা হাজার পরিবার গ্রহণ করছে, আমরা কেউ তা জানি না। এই সংখ্যা লাখ লাখও হতে পারে।
আবার রুটি-রুজি হারানোর ভয়ে ভাসমান কর্মজীবী কিংবা সামাজিকভাবে হেনস্তা হওয়া এড়াতে কতজন উপসর্গ আড়াল করছেন, তারও সঠিক পরিসংখ্যান কেউ দিতে পারবেন না। যাঁদের আয়-রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে এবং সঞ্চয়ও ফুরিয়ে গেছে, তাঁরাও উপসর্গ সত্ত্বেও এখন টাকার অভাবে পরীক্ষা না করাতে বাধ্য হতে পারেন। অথচ রোগ শনাক্ত না হওয়ার কারণে এঁরা সবাই নিজেদের জন্য যতটা ঝুঁকি নেবেন, তার চেয়ে বহুগুণ বেশি ঝুঁকি তৈরি করবেন অন্যদের জন্য, পুরো সমাজের জন্য।
সরকারের পরিপত্র জারি হয়ে গেছে, কিংবা প্রজ্ঞাপন হয়ে গেছে বলে সিদ্ধান্ত পাল্টানো যাবে না, এমন নয়। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই করোনাকালেই দিনের বেলায় জারি করা প্রজ্ঞাপন রাত পেরোনোর আগেই প্রত্যাহার করেছে, সে রকম নজির আছে। চিকিৎসা দিতে অস্বীকৃতি জানালে চিকিৎসকের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনীর কাছে অভিযোগ জারির আদেশ দিয়ে তা কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানেই প্রত্যাহার করা হয়েছিল। সুতরাং সরকারের উচিত হবে এ ধরনের আত্মঘাতী একটি সিদ্ধান্ত অবিলম্বে প্রত্যাহার করে নেওয়া।
মহামারি সামাজিক সংক্রমণের বিষয় এবং পুরো সমাজের জন্য ক্ষতিকর। এটি ব্যক্তি বা পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, থাকবে না। সুতরাং সামাজিক প্রয়োজনে রোগ শনাক্তকরণ, চিকিৎসা এবং ভবিষ্যতে টিকা আবিষ্কৃত হলে সেই প্রতিষেধকও সবার জন্য নিখরচায় নিশ্চিত করতে হবে। সবাই ঝুঁকিমুক্ত না হলে কেউই ঝুঁকিমুক্ত হবে না, এই বাস্তবতার কারণেই বৈশ্বিক পরিসরেও এখন চেষ্টা চলছে করোনা মোকাবিলায় নিখরচায় সবার জন্য এই ব্যবস্থা করার। তবে তা যতক্ষণ না হচ্ছে, ততক্ষণ আমাদের নিজস্ব সম্পদে এই ব্যবস্থা করতে হবে। করোনা মোকাবিলায় বিশ্বব্যাংক বা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো যেসব আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে, তা দিয়ে নতুন ভবনের জন্য বরাদ্দ না দিয়ে বরং রোগ শনাক্তকরণে তা খরচ করাই এখন জরুরি।
* কামাল আহমেদ, সাংবাদিক
Leave a Reply