যেকোনো গণতান্ত্রিক দেশে মানুষের মৌলিক অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা জরুরি। গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ও চেতনারই অংশ এসব বিষয়। সংগত কারণে বাংলাদেশের সংবিধানও এই তিনটি বিষয়ের নিশ্চয়তা দিয়েছে। তার পরও সময়ে সময়ে এমন কিছু আইন করা হয় এবং এমন কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়, যা এই সংবিধানের পরিপন্থী। সম্প্রতি জাতীয় সংসদে পাস হওয়া ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলকেও তেমনি একটি আইন হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বিলটির খসড়া প্রকাশের পর থেকেই এর নির্দিষ্ট কিছু ধারা সম্পর্কে গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন ফোরাম থেকে ব্যাপক আপত্তি জানানো হয়েছিল। তা সত্ত্বেও বিলটি সংসদে পাস হওয়ায় গণমাধ্যমকর্মীরা প্রতিবাদ জানাতে রাস্তায় নেমে আসে। এ অবস্থায় গত রবিবার তিনজন মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন। দীর্ঘ প্রায় তিন ঘণ্টা আলোচনার পর আইনমন্ত্রী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, সম্পাদক পরিষদের আপত্তির কারণগুলো তাঁরা শুনেছেন। এরপর মন্ত্রিসভার বৈঠকে এগুলো নিয়ে কথা হবে। আবারও সম্পাদক পরিষদের সঙ্গে তাঁরা বসবেন। পর্যায়ক্রমে সংবাদপত্রের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংগঠনের নেতাদের সঙ্গেও আলোচনা করবেন এবং তাঁরা একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছার চেষ্টা করবেন।
ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলের মোট ৯টি ধারা (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) নিয়ে সংবাদকর্মীদের ব্যাপক আপত্তি রয়েছে। সম্পাদক পরিষদ এই ধারাগুলোকে স্বাধীন সাংবাদিকতার জন্য হুমকি হিসেবে উল্লেখ করেছেন। সারা দুনিয়ার মতো বাংলাদেশেও সাংবাদিকতার একটি মান তৈরি হয়েছে। সংবাদ সংগ্রহের কিছু নিয়ম, নীতি, পন্থা ও প্রবণতা স্বীকৃতি পেয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলের কিছু ধারায় প্রচলিত সেসব পন্থাকে অস্বীকার করা হয়েছে। সাংবাদিকদের সবচেয়ে বেশি আপত্তি ছিল ৩২ ধারা নিয়ে। সেই ৩২ ধারা প্রায় অবিকৃত রেখেই আইনটি পাস করা হয়েছে। সঙ্গে যোগ করা হয়েছে ঔপনিবেশিক আমলের অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট। সেই মোতাবেক ৩২(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের আওতাভুক্ত অপরাধ কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে সংঘটন করেন বা করিতে সহায়তা করেন তাহা হইলে তিনি অনধিক ১৪ বছরের কারাদ- বা অনধিক ২৫ লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হইবেন।’ আইনের ৩২(২) ধারা অনুযায়ী দ্বিতীয়বার কেউ একই অপরাধ করলে ‘যাবজ্জীবন কারাদ- বা অনধিক এক কোটি টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হইবেন।’ সংবাদপত্রসংশ্লিষ্টরা মনে করেন, এরপর কোনো সাংবাদিকের পক্ষেই সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠানের খবর সংগ্রহ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়বে। তাতে কার স্বার্থ উপেক্ষিত হবে এবং কারা লাভবান হবে? বিলটিতে এখনো রাষ্ট্রপতি স্বাক্ষর করেননি বিধায় মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা। জাতীয় সংসদও বিলটি পুনর্বিবেচনা করতে পারে। আমরা আশা করি, স্বাধীন সাংবাদিকতার কণ্ঠ রোধ হয় এমন যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়া থেকে সরকার বিরত থাকবে।
Leave a Reply