করোনা মহামারীজনিত দীর্ঘ লকডাউন-শাটডাউনে সর্বাধিক বিপন্ন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে দেশের আর্থিক খাতসমূহ। এতে সব না হোক অনেক ছোট-বড় শিল্প-কারখানার চাকা প্রায় স্থবির হয়ে পড়ায় শ্রম ও কর্মজীবীদের আয়-উপার্জন যায় কমে। খেটে খাওয়া দিনমজুর ও কৃষি শ্রমিকদের দৈনিক রুটি-রুজি প্রায় বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম ঘটে। ফলে গরিব আরও গরিব হয়ে পড়ে। অন্য দিকে ক্ষতিগ্রস্ত হন ছোট-বড় শিল্প-কারখানার মালিক এবং উদ্যোক্তারাও। দৈনন্দিন ব্যবসাবাণিজ্য, আমদানি-রফতানি তদুপরি সব রকম যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকায় অর্থনীতির চাকা প্রায় অচল হওয়ার উপক্রম হয়। আপাতত সাত দিনের জন্য দেশে লকডাউন দেয়া হলেও আগামীতে এর সময়সীমা বাড়তে পারে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, করোনার সংক্রমণ থেকে পরিত্রাণ পেতে অন্তত দুই সপ্তাহ তথা ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন অত্যাবশ্যক। কেন্দ্রীয় বাংলাদেশ ব্যাংক লকডাউন পরিস্থিতে সব রকম তফসিলী ব্যাংকের ক্ষেত্রে আড়াই ঘণ্টা লেনদেনের নির্দেশ দিয়েছে। এতে স্বভাবতই শেয়ারবাজারও খোলা থাকবে আড়াই ঘণ্টা। ফলে ইতোমধ্যেই শেয়ার বাজারে ধসের খবর মিলেছে। অন্যদিকে বিদেশী বিনিয়োগ নিয়েও দেখা দিয়েছে শঙ্কা। গত ৮ মাসে যা কমেছে ৭ শতাংশ। সে অবস্থায় সরকার সার্বিক আর্থিক খাতের ক্ষয়ক্ষতি লাঘবে চিন্তা-ভাবনা করেই অগ্রসর হবে বলে প্রত্যাশা। বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়া করোনারভাইরাস বা কোভিড-১৯ এর প্রথম ঢেউয়ের রেশ শেষ না হতেই শুরু হয়েছে দ্বিতীয় ঢেউ। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-কানাডার অবস্থা তো এক কথায় ভয়াবহ। এসব দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার বাড়ছেই। ফলে নতুন করে আরোপ করতে হয়েছে লকডাউনের কঠোর নিষেধাজ্ঞা। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থাও নাজুক। বিশ্বের অনেক দেশের সঙ্গেই আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চলাচল আপাতত বন্ধ রয়েছে অথবা নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আসছে। নতুন ধরনের করোনাভাইরাসের কথাও শোনা যাচ্ছে। অথচ সর্বস্তরে রোগ প্রতিরোধক ভ্যাকসিন প্রয়োগে এখনও অনেক দেরি। সরকার অবশ্য বলছে, ২০২১ এর জুনের মধ্যে অন্তত ৯ কোটি লোককে ভ্যাকসিন দেয়ার প্রস্তুতি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। গুরুত্ব দেয়া হয়েছে মুখে মাস্ক, হাত ধোয়া, স্যানিটাইজার ব্যবহার ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার ওপর। এর পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতি ও ঝুঁকি মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী একনেক বৈঠকে দ্বিতীয় প্রণোদনা প্যাকেজ প্রণয়ন করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টদের। বর্তমান সরকার অবশ্য বিশেষ করে দরিদ্র ও সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে যথাসম্ভব দরিদ্রবান্ধব কর্মসূচী গ্রহণ করেছে। এক কোটি ওএমএস কার্ডের আওতায় অন্তত পাঁচ কোটি জনসংখ্যাকে নিয়ে আসার চেষ্টা চলেছে রেশনিংয়ের আওতায়। দশ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। টিসিবির মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে দেয়া হচ্ছে নানাবিধ নিত্যপণ্য। ব্যক্তিগত সুরক্ষা, স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে অনুমতি দিয়েছে পোশাকসহ শিল্প-কারখানা চালু রাখার। তবে এও সত্য যে, সব শিল্প-কারখানায় সর্বত্র এই শর্ত মানা সম্ভব নয়। এগুলোর সঙ্গে শ্রমজীবীর আহার, বাসস্থান, যাতায়াত ইত্যাদিও জড়িত। এর পাশাপাশি রোজা ও ঈদ-উল-ফিতরকে সামনে রেখে সর্বস্তরের মানুষের চাহিদাও বেড়ে যাবে অনেকগুণ। এ পর্যায়ে কোটি কোটি শ্রমজীবীর বেতন-বোনাসের বিষয়টিও জড়িত ওতপ্রোতভাবে। এর জন্য সরকারী প্রণোদনার পাশাপাশি আবশ্যক বেসরকারী উদ্যোগও। সরকার পোশাক খাত, কৃষি, শিল্প সেক্টরসহ বিভিন্ন পর্যায়ে গত বছর প্রায় এক লাখ ২০ কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা দিয়েছিল। জাতীয় প্রবৃদ্ধির ধারা এবং অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তা সহায়ক হয়েছে নিশ্চয়ই। সে অবস্থায় যথাযথ সুরক্ষায় নিয়ে শিল্প-কারখানাসহ মেগা প্রকল্পগুলো সচল এবং সর্বস্তরের মানুষ সচেতন হলে জীবন-জীবিকা চলতে পারে হাত ধরাধরি করে।
Leave a Reply