এবার বাংলা নববর্ষ আসছে এমন এক সময়ে যখন করোনাভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রাণঘাতী আক্রমণে শুধু বাংলাদেশই নয়; বরং প্রায় সমগ্র বিশ্বই পুনরায় পর্যুদস্ত। সভ্যতার ইতিহাসে মানুষ ইতোপূর্বে গুটিবসন্ত, হাম, প্লেগ, কলেরা, ম্যালেরিয়া, ইনফ্লুয়েঞ্জা, মার্স, সার্স, ইবোলা ভাইরাস ইত্যাদি মহামারীর মোকাবেলা করেছে। সে সব ভয়াবহ হন্তারক ব্যাধির বিরুদ্ধে প্রতিষেধক টিকা এবং ওষুধ আবিষ্কার করে বিজয়ীও হয়েছে। করোনার বিরুদ্ধে মানুষ অদ্যাবধি শতভাগ দাবিদার কোন প্রতিষেধক আবিষ্কার করতে পারেনি। তবে টিকা আবিষ্কার করেছে এবং তার প্রয়োগও চলছে। আপাতত অদৃশ্য এই ভয়ঙ্কর হন্তারক ভাইরাসটির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের হাতিয়ার কেবল যাবতীয় সঙ্গ নিরোধসহ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা। বর্তমানে সারাদেশে চলছে লকডাউন। সর্বত্র প্রায় অন্তরীণ অবস্থা। যে কারণে পহেলা বৈশাখকে বরণ করে নেয়ার জন্য ঐতিহ্যবাহী ছায়ানটের অনুষ্ঠান, মঙ্গল শোভাযাত্রা, গ্রামীণ মেলা, মিলন উৎসবÑ সব কিছু প্রায় বন্ধ। এ সংক্রান্ত অনুষ্ঠান চলবে কেবল টিভি ও গণমাধ্যমে। ডিজিটাল ও ভার্চুয়াল জগতে। তবু মনেপ্রাণে হলেও বলতেই হবে, এসো হে বৈশাখ এসো এসো…জীর্ণ পুরাতন ভেসে যায়। আসে নতুন এবং তার আবাহন। ধ্বনিত হয়, ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা।’ চিরায়ত বাঙালীর জীবনের এক প্রাণস্পর্শী দিনের শুরু গতকাল ভোরের সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে। নতুনের কেতন উড়িয়ে বৈশাখ দেয় নতুনেরে ডাক, খোলো খোলো দ্বার। বাংলার মাটি, বাংলার সবুজ- শ্যামল, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফলÑ সবখানেই চির নতুনের আবাহন জেগে উঠছে ভোরের রাঙা সূর্যালোকে। বিদায় নিয়েছে পুরনো বছর ১৪২৭। এসেছে নতুন বছর ১৪২৮। বাঙালীর নববর্ষ। এবারের নববর্ষ এসেছে এক নতুন বাস্তবতায়, করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলার বার্তা নিয়ে। স্বাগত নববর্ষ, ১৪২৮। পহেলা বৈশাখ বাঙালীর প্রিয় দিন। নববর্ষ হোক উত্থানের। নতুন বর্ষে জঙ্গীবাদ-সন্ত্রাসবাদ-করোনা হোক চিরতরে নির্মূল। নাশকতা, সহিংসতা বন্ধ হোক। স্বদেশ হোক নৈরাশ্যমুক্ত। পহেলা বৈশাখ বাঙালীর নববর্ষ। বৈশাখ বাঙালীর জীবনে কী গ্রামে কী শহরে এক নতুন সমারোহ নিয়ে আসে। হালখাতার পাতা খুলে যেমন তার বাণিজ্যের পুণ্যাহ উৎসব, তেমনি সাধারণ জীবনযাত্রায়ও থাকে প্রবল একটা প্রাণচাঞ্চল্যÑ ধ্বনিত হয় ‘মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,/অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।’ বৈশাখ মানে গ্রীষ্ম ঋতুর শুরু। উজ্জ্বল রৌদ্রময় দিন। তেমনি আবার কালবৈশাখীর বজ্র-বিদ্যুতসহ ভয়াল রূপ। জীবন সংগ্রামের দীক্ষা লাভের নানা রূপের সংমিশ্রণ নববর্ষের সূচনালগ্ন। এই সূচনালগ্নে নতুন ভাবনা-চিন্তায় কতটা এগিয়েছি আমরা তারও মূল্যায়ন করা দরকার। নতুন বছরে পদার্পণের অর্থই হলো নতুনের মুখোমুখি হওয়া। সামনের দিনগুলোকে নবউদ্যমে বিনির্মাণের তাগিদ। আমাদের উদ্যম, আমাদের অধ্যবসায় সব নিয়োজিত হোক জাতীয় উন্নয়নের লক্ষ্যে। উৎসবের আনন্দ নতুন সঙ্কল্পে দীক্ষিত জাতির ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার নতুন শক্তির প্রেরণা হোক। এ জন্য সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ ও প্রচেষ্টা প্রয়োজন। বাংলা নববর্ষ সুর-সঙ্গীতের, মেলা-মিলনের, আনন্দ ও উৎসবের, সাহস ও সঙ্কল্পের প্রেরণা জোগায়। এবার এসব চলবে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। দুঃখ-গ্লানি, অতীতের ব্যর্থতা পেছনে ফেলে তাই এগিয়ে যাওয়ার শপথ নেয়ার দিনও পহেলা বৈশাখ। দেশ ও জাতির কল্যাণে সবাই এক কাতারে শামিল হয়ে এগিয়ে যাওয়ার অগ্নিশপথ নেয়ার দিন এটি। পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনেও বৈশাখের চেতনায় উজ্জীবিত হোক সবাই। নতুন ভবিষ্যত গড়ার প্রত্যয়ে সবাই হোক উদীপ্ত। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা। স্বাগত ১৪২৮।
Leave a Reply