নিজস্ব প্রতিবেদক ॥ বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কে পায়রা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয় ২০১২ সালে। সে সময় প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৪১৩ কোটি ২৯ লাখ টাকা। এর নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৬ সালে। যদিও সেতুর ফাউন্ডেশনের কাজ শুরু হয় এরও এক বছর পর। তিন দফায় মেয়াদ বাড়িয়ে বর্তমানে সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করার সময় ধরা হয়েছে ২০২২ সালের জুন। বারবার দীর্ঘায়িত হওয়ায় বর্তমানে সেতুর নির্মাণ ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৪৪৭ কোটি ২৪ লাখ টাকায়। সে হিসেবে বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রতায় প্রকল্পের ব্যয় বেড়েছে ২৫০ শতাংশেরও বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানান, ব্যয় ও মেয়াদ বাড়ানোর জন্য একনেকে অনুমোদন পাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত পাঁচবার সংশোধন করতে হয়েছে প্রকল্পটি। সর্বশেষ সংশোধনী অনুযায়ী নির্ধারিত সময়ের মধ্যেও এটি শেষ হবে কিনা, সে বিষয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী অগ্রগতির চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২ সালের জুনে পায়রা সেতুর কাজ শেষ করতে গত মে মাস পর্যন্ত অগ্রগতির লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৮৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ। কিন্তু আদতে সে সময় পর্যন্ত অগ্রগতি হয়েছিল সাড়ে ৫৮ শতাংশ।
পায়রা সেতু নির্মাণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর। সংস্থাটিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাস্তবায়নে দীর্ঘসূত্রতার কারণে প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন, পূর্ত কাজ, মূল সেতু নির্মাণ, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, পরামর্শক সেবাসহ আনুষঙ্গিক সব খাতেই কয়েক গুণ ব্যয় বেড়েছে। এভাবে ব্যয় বাড়ার কারণ হিসেবে শিডিউল অব রেটকে দায়ী করছেন সওজ প্রকৌশলীরা। তাদের দাবি, শুরুতে প্রকল্পটির ব্যয় প্রাক্কলন করা হয়েছিল অধিদপ্তরের ২০১১ সালের শিডিউল অব রেট অনুযায়ী। কিন্তু নির্মাণকাজ শুরু করতে দেরি হওয়ায় সব ধরনের কেনাকাটা করতে হয়েছে ২০১৫ সালের শিডিউল অব রেটে। পাশাপাশি নকশা সংশোধন ও পূর্ত কাজের পরিমাণ বাড়ার কারণেও সেতুর নির্মাণ ব্যয় বেড়েছে। খাতভিত্তিক ব্যয় বিশ্লেষণে দেখা যায়, শুরুতে প্রকল্পের সাইট অফিস নির্মাণ ও প্রয়োজনীয় ফার্নিচার সংগ্রহের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ২ কোটি ৯৩ লাখ টাকা। এ ব্যয় এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২৭ কোটি ৯৬ লাখ টাকায়। সাইট অফিস ও ফার্নিচার সংগ্রহের পাশাপাশি টোল প্লাজা ও ফেরিঘাট স্থানান্তরও এ প্যাকেজে যুক্ত রয়েছে বলে সওজ প্রকৌশলীরা জানিয়েছেন।প্রকল্পের মূল ডিপিপিতে নিরাপত্তাকর্মী সেবা বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ কোটি ৭১ লাখ টাকা। একইভাবে প্রকল্পটির জন্য পরামর্শক সেবা বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছিল ২৪ কোটি ১৫ লাখ টাকা। কাজে বিলম্ব হওয়ায় এ খাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪২ কোটি ৫৬ লাখ টাকা।
প্রকল্পটির মূল কাজ বা শুধু সেতু নির্মাণের জন্য শুরুতে ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩০৪ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। বর্তমানে এ নির্মাণ ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৭২২ কোটি ৪৭ লাখ টাকায়। অর্থাৎ প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতায় সেতু নির্মাণের ব্যয় বেড়েছে ৪১৭ কোটি ৬৩ লাখ টাকা। শিডিউল অব রেট পরিবর্তনের পাশাপাশি সেতুর নকশায় কিছুটা পরিবর্তন আসায় নির্মাণ ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কথা বলছে সওজ অধিদপ্তর। সেতুটির জন্য শুরুতে পাঁচ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের পরিকল্পনা ছিল। এজন্য ব্যয় ধরা হয়েছিল ৬ কোটি ৮০ লাখ টাকা। পরবর্তী সময়ে আরো জায়গার প্রয়োজনীয়তা দেখা দিলে সব মিলিয়ে ১০ দশমিক ৩ হেক্টর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়। আর এ খাতে ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ২৮ কোটি ৬০ লাখ টাকায়। এর কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটির কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে চার বছরের বেশি। এ সময়ে জমির দাম বেড়ে দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে। পায়রা সেতুর পার্শ্ববর্তী নদী সংরক্ষণের জন্য প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৮ কোটি টাকা, ৩০২ কোটি টাকা বেড়ে যা এখন ৩২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। একইভাবে সেতুর দুইপাশে সংযোগ সড়ক নির্মাণ ব্যয় ৯ কোটি থেকে বেড়ে উন্নীত হয়েছে ৪২ কোটি ৩৭ লাখ টাকায়। সেতুটির নির্মাণকাজ যথাসময়ে শেষ হওয়া নিয়ে আশঙ্কা বাড়িয়েছে নভেল করোনাভাইরাসের সংক্রমণ। মহামারীর কারণে বিদেশী প্রকৌশলী-শ্রমিকদের অনেকেই যেমন কাজে যোগ দিতে পারেননি, তেমনি স্থানীয় শ্রমিকদেরও ঘাটতি রয়েছে। বিষয়টি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে পায়রা সেতুর প্রকল্প ব্যবস্থাপক আহমদ শরীফ বলেন, প্রকল্পে নিয়োজিত সব বিদেশী কর্মী এখনো কাজে যোগ দিতে পারেননি। ২৫ জনের মতো বিদেশী কর্মী আসার অপেক্ষায় রয়েছেন। ভিসা জটিলতার কারণে তাদের আসতে দেরি হচ্ছে। এর মধ্যে ২ ও ১২ অক্টোবর যথাক্রমে দুই ও আটজনের আসার কথা রয়েছে। আমরা আশা করছি এক মাসের মধ্যে সবাই কাজে যোগ দিতে পারবেন। তাদের অনুপস্থিতিতে নির্মাণকাজ কিছুটা পিছিয়ে পড়েছে। মূল সেতুর কাজে তেমন কোনো সমস্যা না হলেও নদীশাসন কাজ বেশ বিঘিœত হচ্ছে বলে জানিয়েছেন আহমদ শরীফ শজিব। তিনি বলেন, এবার বর্ষার প্রকোপ বেশি হওয়ায় ডাম্পিং কাজ ঠিকমতো করা সম্ভব হচ্ছে না। পাশাপাশি এ কাজে নিয়োজিত বিদেশী প্রকৌশলীরাও বাংলাদেশে নেই। পায়রা সেতু প্রকল্পে গত মঙ্গলবার প্রকল্প পরিচালক হিসেবে যোগ দেন সওজ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মোহাম্মদ আবদুল হালিম। যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, সমস্যা কাটিয়ে নির্ধারিত সময়ে সেতুর কাজ শেষ করাই আমাদের মূল লক্ষ্য।
Leave a Reply