কলাপাড়া প্রতিনিধি ॥ দেড় বছরের বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় শুধু দুই স্কুলের শতাধিক ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। এছাড়া উপজেলার প্রায় প্রতিটি স্কুলেই এমন চিত্র দেখা যায়। জানা গেছে, উপকূলীয় অঞ্চল হওয়ায় কলাপাড়ায় আগে থেকেই বাল্যবিয়ে প্রবণতা ছিল। তবে করোনায় দীর্ঘ সময় প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সেটি আরও বেড়েছে। কলাপাড়া উপজেলায় জাগো নারী, আভাসসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা ও প্রশাসনের উদ্যোগে নানা কর্মসূচির কারণে বাল্যবিয়ের হার প্রায় অর্ধেক কমলেও করোনার সময় সে হিসাব পাল্টে দিয়েছে। উপজেলার বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেশিরভাগ বিদ্যালয়ে করোনাকালীন সময়ে ২৫-৩০ ছাত্রীর বিয়ে হয়েছে। শুধু ৫০ জনের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে ধুলাশ্বার ইউনিয়নের চরচাপলি ইসলামিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও একই ইউনিয়নের ধুলাশ্বার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। চরচাপলি ইসলামি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গাজী আলী আহম্মেদ জানান, প্রাথমিকভাবে খোঁজ নিয়ে জেনেছি সপ্তম-দশম শ্রেণি পড়ুয়া আনুমানিক ৫০ জনের বেশি ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। তাদের মধ্যে কোনো ক্লাসের কতজন সেটা আপাতত বলতে পারছি না। তবে স্কুল খোলার পরে বলতে পারবো।
তিনি আরও জানান, ২০১৯ সালে বাল্যবিয়ের সংখ্যাটা ২৫-৩০ এর মধ্যে থাকলেও করোনার কারণে ২০২১ সালে তা দুই-তিন গুণে দাঁড়িয়েছে। বাল্যবিয়ে হওয়া ছাত্রীদের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা বিভিন্ন অযুহাত দিচ্ছে। আমি কয়েকজন মেধাবী ছাত্রীর পরিবারকে সম্পূর্ণ ফ্রিতে পড়ানোর প্রস্তাব দিলেও তারা তা শোনেনি। বাল্যবিয়ের শিকার ওই বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাবা জানান, মেয়েকে নিয়ে কোনো বদনাম হওয়ার আগেই তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়েছি। ধুলাশ্বার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ইব্রাহিম হোসেন জানান, বাল্যবিয়ে হওয়া বেশিরভাগই অষ্টম-দশম শ্রেণির ছাত্রী। শুধু নবম শ্রেণির ৩০ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে।
এছাড়া অষ্টম, নবম ও দশম শ্রেণি মিলে কমপক্ষে ৫৫-৬০ ছাত্রীর বাল্যবিয়ে হয়েছে। বিয়ের খবর শুনে যখন পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করি তখন তারা বলেন, ‘স্যার মেয়ে তো শ্বশুর বাড়ি থাকে, শুধু ধর্মীয়ভাবে বিয়ে দিয়েছি, রেজিস্ট্রার বয়স হলে করবো।’ গঙ্গামতি এলাকায় বাল্যবিয়ের স্বীকার এক পরিবার বলেন, ‘গরীব মানুষ। সাগরে মাছ ধরে খাই, অনেক দিন পর পর সমুদ্র থেকে বাড়িতে আসি। দিনকাল ভালো না-কখন কি হয়ে যায় বলা যায় না। স্কুলও বন্ধ তাই ভালো ছেলে পেয়ে মেয়ের বিয়ের দিয়েছি।’ উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসের তথ্য মতে, কলাপাড়ায় সর্বমোট ৩৩ মাধ্যমিক বিদ্যালয় রয়েছে। প্রাথমিক শিক্ষার ধাপ পেরিয়ে ২০২০ সালে ষষ্ঠ শ্রেণীতে শিক্ষার্থীদের ভর্তির সংখ্যা ছিল তিন হাজার ১৬৬। কিন্তু ২০২১ সালে সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে দুই হাজার ৮০০ জনে। স্থানীয় সমাজসেবক লুৎফুল হাসান রানা জানান, আইনসঙ্গত উপায়ে বর্তমানে বাল্যবিয়ের নিবন্ধন কোনো কাজী করতে পারে না।
কিন্তু এলাকায় যে কাজীরা রয়েছে তারা নকল নিবন্ধন ফরমে সই নিয়ে বিয়ে সম্পন্ন করছে। পরে যখন ছাত্রীদের বয়স ১৮ বছর পূর্ণ হবে তখন রেজিস্ট্রেশন করবে। ফলে তারা আইনের চোখে নির্দোষ থেকে যায়। ধুলাস্বার ইউপি চেয়ারম্যান আ. জলিল মাস্টার বলেন, দুই স্কুলের এতো ছাত্রীর বিয়ে কীভাবে হয়েছে তা জানা নেই। এ বিষয়ে ইউনিয়ন পরিষদের কাছে কোনো তথ্যও নেই। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা আভাসের নির্বাহী পরিচালক জাহিমা সুলতানা কাজল বলেন, বেশ কয়েকবছর ধরে কলাপাড়ায় বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ ও শিশু নির্যাতন বন্ধে কাজ করছি। করোনার আগে উপজেলায় বাল্যবিয়ের হার অর্ধেকে নেমে এসেছিল। তবে আবার কাজ শুরু হয়েছে। আরও কিছু দিন পরে বলা যাবে যে বাল্য বিবাহের সংখ্যাটা কেমন।
বেসরকারি সংস্থা ‘জাগো নারী’ কলাপাড়ার দায়িত্বে থাকা মোহাম্মদ আল-ইমরান জানান, গত দেড় বছর করোনার কারণে স্কুল বন্ধ থাকায় বাল্যবিয়ে বেড়েছে। তবে সঠিক জরিপ ছাড়া এ মুহূর্তে সংখ্যাটা বলা সম্ভব নয়। বিষয়টি নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। কলাপাড়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোখলেছুর রহমান বলেন, প্রাথমিকভাবে জেনেছি অনেক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। তবে সঠিক সংখ্যাটা বলতে পারছি না। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক জানান, এ তথ্যটা আমার কাছে ছিল না। খোঁজ নেব, যদি এমনটা হয় তাহলে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেয়া হবে।
Leave a Reply