হন্তারক মহামারী করোনাভাইরাস মোকাবেলার পাশাপাশি বাংলাদেশের কৃষককে লড়াই করতে হয়েছে প্রতিকূল প্রকৃতির বিরুদ্ধেও। এবার উপর্যুপরি তিন দফা বন্যায় ৩৭টি জেলার অন্তত ২ হাজার ৩২৩ কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যার মধ্যে অন্যতম আমন ধান। বন্যায় তলিয়ে যাওয়া ফসলি জমির পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৫৭ হাজার ১৪৮ হেক্টর। এর মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত জমির পরিমাণ ১ লাখ ৫৮ হাজার ৮১৪ হেক্টর। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা ১২ লাখ ৭২ হাজার ১৫১ জন। কৃষকবান্ধব সরকার সেক্ষেত্রে কৃষকদের পাশে দাঁড়াবে; সেটাই স্বাভাবিক সঙ্গত ও প্রত্যাশিত। সরকার যথারীতি তার কথা রেখেছে। অতিমারী করোনাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি পূরণ করতে এবং ফসল উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে চলতি ২০২০-২১ অর্থবছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৭ লাখ কৃষককে ৩৭২ কোটি টাকার প্রণোদনা দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়। নগদ সহায়তার পাশাপাশি প্রণোদনার আওতায় এসেছে বীজ, সার, চারা, কৃষিযন্ত্রসহ কৃষি উপকরণ এবং আনুষঙ্গিক সহায়তা। বোরো ধানের পাশাপাশি বিভিন্ন রবিশস্য এবং পেঁয়াজ ও তেলবীজের আবাদ বাড়াতেও দেয়া হয়েছে স্বল্পসুদে কৃষিঋণসহ নানা সহায়তা, যাতে সরাসরি উপকৃত হন কৃষক। বিশ্বে ধান উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়। স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের এই অভূতপূর্ব বিস্ময়কর উত্তরণ বিশ্বেরও বিস্ময় বৈকি। আর এ সবই সম্ভব হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দূরদৃষ্টিসম্পন্ন জাতীয় নীতি এবং পরে তার সুযোগ্যকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাস্তবানুগ কৃষি কৌশল অবলম্বন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে। বর্তমানে বাংলাদেশ বিশ্বে ধান উৎপাদনে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে অবস্থান করে সমাদৃত হয়েছে বিশ্ব পরিমন্ডলে। ২০০৯ সালে খাদ্য শস্যের উৎপাদন ছিল ৩ কোটি ৩৮ লাখ ৩৩ হাজার টন। বর্তমানে খাদ্য শস্যের উৎপাদন বেড়ে হয়েছে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার টন। মাছ বিশেষ করে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনেও বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ঈর্ষণীয়- চতুর্থ স্থানে রয়েছে। তবে ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে অদ্বিতীয়, একেবারে প্রথম স্থানে। কৃষিই বাংলাদেশের সামগ্রিক অর্থনীতির প্রাণ। সেই অনাদিকাল থেকেই দেশের মানুষ খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানসহ মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য নির্ভর করেছে কৃষির ওপর। দেশে গত কয়েক বছরে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রভূত শিল্পায়ন সাধিত হলেও মূলত কৃষিই যে বাংলাদেশের আয়-উন্নতির প্রাণভোমরা, এ কথা অস্বীকার করা যাবে না কিছুতেই। মনে রাখতে হবে যে, দেশের ৭০ শতাংশ মানুষ এখনও গ্রামে বসবাস করে এবং তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে কৃষি ও সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পেশায় জড়িত। করোনা মহামারীজনিত একটানা দীর্ঘ ৬৬ দিন লকডাউনে দেশের শিল্প-কারখানাসহ প্রায় সব কার্যক্রম বন্ধ অথবা স্থগিত থাকলেও কৃষিকাজ থেমে থাকেনি একদিনের জন্যও। যে কারণে বোরো-আমনের বাম্পার ফলন হয়েছে। কৃষক ধান-চালের আশানুরূপ দাম পেয়েছে। অন্যদিকে প্রায় ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশে কেউ না খেয়ে থাকেনি। মারা যায়নি অনাহারে। মোটকথা কৃষিই মূলত বাঁচিয়ে রেখেছে বাংলাদেশকে। সরকারও বিষয়টি সম্যক অনুধাবন করে চলতি বোরো মৌসুমে বিশেষ করে সেচকাজে পানি সরবরাহ ব্যবস্থা সর্বক্ষণ সচল রাখার জন্য ফেব্রুয়ারি-মে মাস পর্যন্ত গ্রামাঞ্চলে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুত দিতে বলেছে সংশ্লিষ্ট বিভাগকে। এর পাশাপাশি ভর্তুকি মূল্যে বিভিন্ন সার, বীজ, কীটনাশক, সরলসুদে কৃষিঋণ সর্বোপরি নগদ প্রণোদনা তো রয়েছেই, যা ইতিবাচক অবদান রাখছে জাতীয় অর্থনীতিতে। বর্তমান জনবান্ধব ও কৃষিবান্ধব সরকারের অন্যতম একটি সাফল্য, দেশের সর্বস্তরের মানুষের জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। এটি সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকারও বটে। এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের লাগসই কৃষিনীতির বাস্তবায়নসহ যথাসময়ে কৃষকের হাতে উন্নতমানের বীজ ধান, ধানের চারা, সেচসুবিধা, ডিজেল ও বিদ্যুত সর্বোপরি বালাইনাশক পৌঁছে দেয়ায় গত কয়েক বছর ধরে ধানের বাম্পার ফলন হচ্ছে। কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমে দেশ আজ শুধু খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, বরং উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্যে ভরপুর। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর হতে চললেও অদ্যাবধি আমরা একটি সমন্বিত ও আধুনিক কৃষিপণ্য বিপণন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারিনি। ফলে একদিকে উৎপাদিত ফসল ও পণ্যদ্রব্যের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হয় কৃষক; অন্যদিকে সেসব পণ্য উচ্চমূল্যে কিনতে হয় ভোক্তা তথা ক্রেতা সাধারণকে। সে অবস্থায় দেশে ধান-চাল-পাটসহ কৃষিজাত পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার জন্য তৃণমূল থেকে রাজধানী পর্যন্ত একটি আধুনিক ও সমন্বিত মার্কেটিং ব্যবস্থা গড়ে তোলা জরুরী ও অপরিহার্য।
Leave a Reply