করোনা মহামারীর অনেক দুর্ভোগ মানুষের চলমান জীবনের ওপর যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করে তার পরিণামে মূল্যবান জীবনকেও বিপন্ন করে তুলছে। জীবন ও জীবিকায় এসেছে এক অনাকাক্সিক্ষত দুঃসময়। সামাজিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষায় নতুনভাবে যে বিপর্যয় তাতে নিজ থেকে জীবন বলি দেয়ার ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। আত্মহত্যার মাত্রা গত এক বছরে বেড়ে যাওয়ার দুঃসংবাদ আমাদের হতচকিত ও বিপন্ন করে তুলছে। এক তথ্যে উঠে আসে গত দশ মাসে আত্মহত্যা করেছেন প্রায় ১১ হাজার নারী-পুরুষ। অবশ্য গত এক বছরে নারী ও শিশুর ওপর অমানবিক নৃশংসতার চিত্রও ক্রমান্বয়ে বাড়ারই দিকে। তবে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় মাদকাসক্তি, বিষণ্নতা, মানসিক অবসন্নতা ছাড়া অত্যধিক আবেগাচ্ছন্ন হয়ে কিছু স্পর্শকাতর মানুষ নিজের জীবনকে অকারণে অপ্রয়োজনে উৎসর্গ করছে। এদিকে গত বছরের তুলনায় এ বছর আত্মহত্যার হার বেড়েছে ১৩%। পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক তথ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এমন অযাচিত আত্মহত্যায় নারীদের সংখ্যা উর্ধগতি। আশঙ্কাজনকভাবে এমন সংখ্যা বৃদ্ধির হার আগের তুলনায় ২০.৭১% বেশি। যা সত্যিই হতাশাব্যঞ্জক এবং উদ্বেগজনক। এদিকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও এক প্রতিবেদনে উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে- সারা পৃথিবীতে ৩০ কোটি মানুষ বিষণ্নতা এবং অবসন্নতায় ভুগছে। যা মানুষের জীবনের সুস্থ বিকাশের ওপর এক অশনিসঙ্কেত। আর বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ৪.৬ শতাংশ এই মানসিক ভারাক্রান্তের শিকার। যা ৭৪ লাখেরও বেশি। গত দশ বছরে বিশ্বব্যাপী এই মানসিক ভারসাম্যের অবস্থা বেড়েছে প্রায়ই ১৮%। আর এই মানসিক বিপন্নতায় প্রতি ৪০ সেকেন্ডে ১জন মানুষ নিজেকে আত্মাহুতি দিচ্ছে। যা মোটেও কারও জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। চরম সঙ্কট মোকাবেলা করতে যে জীবনকে বলি দিচ্ছে সেখানেই শেষ কথা নয়। তার স্বজনদের পরবর্তী মানসিক বিকার ঠেকানোও মুশকিল হয়ে যায়। এমন মানসিক সঙ্কট নিয়ে মনোরোগ বিশেষজ্ঞরাও ভাবছেন। তাদের মতে অনেক কারণে ব্যক্তি মানুষের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা লক্ষণীয়। পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে মানুষ নিজের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়ে। জীবনের মায়া ত্যাগ করাও যেন তখন কোন ব্যাপার নয়। ভালবাসার আরাধ্য মানুষের কাছ থেকে কষ্ট পাওয়ার যন্ত্রণা এক সময় অসহনীয় পর্যায়ে ঠেকে। যা সংশ্লিষ্ট মানুষকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়। সবচাইতে তীব্রতর সঙ্কট জীবন ও জীবিকায় চরম দুর্ভোগ। অর্থনৈতিক দুরবস্থায় পড়ে মানুষ আত্মহত্যার মতো বিপজ্জনক সঙ্কটকে আলিঙ্গন করতে পিছপা হচ্ছে না। আবার বাবা-মার মাত্রাতিরিক্ত শাসন সন্তানদের দিশেহারা করে দেয়। অভিঘাতে, অভিমানে তখন মূল্যবান জীবনকে তুচ্ছও মনে হয়। নারী-পুরুষের দাম্পত্য জীবনের হরেক রকম বিপর্যয়ও আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হতে পারে। অন্য জনের প্রতি আসক্তি, অবৈধ সম্পর্ক সংশ্লিষ্টদের মধ্যে এক ধরনের আশঙ্কাজনক বিচ্ছিন্নতা তৈরি করে। কোন এক সময় রেহাই পেতে তারা মৃত্যুকে বেছে নিতে বাধ্য হয়। তবে ‘আত্মহত্যা’ প্রত্যয়টি নতুন কিছু নয়। সেই পুরাকাল থেকেই এমন প্রবণতা দৃশ্যমান হলেও আধুনিক শিল্পোন্নত, প্রযুক্তির বিশ্বে তা ক্রমান্বয়ে বাড়ার চিত্র সবাইকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে। দীর্ঘস্থায়ী দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যেও আত্মহত্যার ঝোঁক লক্ষ্য করা যায়। কোভিডকালীন করোনার মৃত্যুর চেয়েও আত্মহত্যায় প্রাণ বিসর্জন দেয়ার সংখ্যা বেশি। অনেক সময় লঘু পাপে গুরুদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তির মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্প্রতি টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে কিশোর-কিশোরীর প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে সামাজিক সালিশ ডাকা হয়। সেখানে সবার সামনে তাদের দুজনকে জুতোপেটা করা হয়। লজ্জায়, অপমানে কিশোরী মেয়েটি আত্মহত্যা করে সমস্ত অসম্মানের ইতি ঘটায়। সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী এমন অমানবিক প্রবণতাকে সুরক্ষা দিতে পারে। সমাজের সামগ্রিক ব্যবস্থা সর্বমানুষের জীবন মানের উপযোগী হতে পারাটাও এক প্রকার সামাজিক নিশ্চয়তা। ব্যক্তি মানুষকেও ঠাণ্ডা মাথায় বিচক্ষণতার সঙ্গে তার সঙ্কটের সময়কে মোকাবেলা করাও একান্ত জরুরী। স্বেচ্ছায় জীবন ত্যাগ কোনভাবেই কাম্য নয়।
Leave a Reply