রবীন্দ্রসঙ্গীতের সাধক-শিল্পী মিতা হকের অকালপ্রয়াণ আমাদের সংস্কৃতি অঙ্গনের জন্য এক বড় দুঃসংবাদ। করোনাকালে তাঁর এই মৃত্যু বড় বেদনার মতো বেজেছে। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল ছিলেন তিনি। শুদ্ধ সুর ও বাচনে পরিশীলিত সুরেলা কণ্ঠে তাঁর পরিবেশিত গানের মুগ্ধ অনুরাগী ছিলেন সারস্বত সমাজের বহু বিশিষ্টজন। তিনি শুধু আমাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ শিল্পীই ছিলেন না, ছিলেন শিল্পী গড়ার কারিগরও। ছায়ানট নামের সঙ্গীত-তীর্থভূমির রবীন্দ্রসঙ্গীত বিভাগের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বহু বছর। সুরতীর্থ নামে তাঁর নিজেরও একটি সঙ্গীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয়ও তিনি রেখে গেছেন বাংলাদেশ রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্মিলন পরিষদের সঙ্গে যুক্ত থেকে। করোনাই তাঁকে কেড়ে নিল। বেশ কয়েক বছর জটিল কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন। নিয়মিত কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হতো তাঁকে। করোনাক্রান্ত হওয়ার পর ভয়ঙ্কর ভাইরাসের সঙ্গে লড়ে তিনি সুস্থ হন ঠিকই, কিন্তু কোভিড পরবর্তী জটিলতা সামলে উঠতে পারেননি। তাঁর মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, বাংলাদেশে রবীন্দ্রচর্চা এবং রবীন্দ্রসঙ্গীতকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর প্রচেষ্টা মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে। মিতা হকের সঙ্গীতশিক্ষার সূচনা পিতৃব্য সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ওয়াহিদুল হকের কাছে। পরে ছায়ানটের আরেক শীর্ষ ব্যক্তিত্ব সন্জীদা খাতুনের কাছেও তিনি সঙ্গীত শিক্ষা লাভ করেন। সতীর্থ ও সমকালীন সুহৃদদের চোখে তিনি ছিলেন বিশিষ্ট। ভালবাসা ও শ্রদ্ধার মানুষ। মিতা হকের মৃত্যুতে শোক ও শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে গিয়ে তার অন্তরঙ্গ প্রতিকৃতি সর্বসাধারণ্যে স্বচ্ছ ও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। শিল্পী সাদি মহম্মদের মতে তাঁর মতো বড় মাপের একজন শিল্পীর যথেষ্ট মূল্যায়ন হয়নি। মিতা হকের আজীবন সম্মাননা প্রাপ্তির স্মৃতিচারণ করে শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা বলেছেন, আজীবন সম্মান জানানোর মতোই ছিলেন তিনি। শিল্পী অদিতি মহসিনের কণ্ঠে হাহাকার ঝরে পড়েÑ একজন অসাম্প্রদায়িক চেতনার ভাল মনের শিল্পীকে আমরা হারালাম। মিতা হক শ্রুতিধরের মতো একবার শুনলেই কণ্ঠে নির্ভুলভাবে তুলে নিতে পারতেন গান, একবার স্বরলিপি দেখলে কখনোই ভুল হতো না তাঁর, এই পর্যবেক্ষণ শিল্পী লাইসা আহমেদ লিসার। ব্যক্তিজীবনে একুশে পদকপ্রাপ্ত শিল্পী মিতা হক একটু নিভৃতে থাকতেই পছন্দ করতেন। নিজের মতো, তা যত আপাত-অপ্রিয় হোক না কেন, সেটি প্রকাশে কুণ্ঠিত ছিলেন না। মিতা হকের মতো খোলা মনের স্পষ্টবাদী মানুষের বড় অভাব এ কূপম-ূক সমাজে। সংগ্রামী মানুষ ছিলেন তিনি। স্বামী বিশিষ্ট অভিনয়শিল্পী খালেদ খানের অকাল মৃত্যুর পর একমাত্র কন্যাকে নিয়ে জীবনের বন্ধুর পথ অতিক্রম করেছেন এই গুণী শিল্পী। নব্বই সালে তাঁর প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের এ্যালবাম প্রকাশিত হয়। এ পর্যন্ত বাংলাদেশ ও ভারত মিলিয়ে তাঁর একক এ্যালবামের সংখ্যা চব্বিশ। পশ্চিমঙ্গেও সমান সুখ্যাতি ছিল তাঁর। সেখান থেকেই বেশি গানের এ্যালবাম বেরিয়েছে তাঁর। মানুষ তাঁর কাজের মধ্য দিয়েই স্মরণীয় হয়ে থাকেন। মিতা হকও সপ্রাণ ও সুপ্রিয় হয়ে থাকবেন সঙ্গীতপ্রেমীদের কাছে, যুগ থেকে যুগান্তরে। এমন উচ্চারণ অত্যুক্তি নয়। ইতোমধ্যে আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়েছেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক ও চেয়ারম্যান বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী শামসুজ্জামান খান এবং বিশিষ্ট আইনজীবী সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি সাবেক আইনমন্ত্রী আব্দুল মতিন খসরু। আমরা তাঁদের বিদেহী আত্মার মাফফেরাত কামনাসহ স্বজনদের জানাই গভীর সমবেদনা।
Leave a Reply