একের পর এক ট্র্যাজেডি ঘটে, মানুষের অপমৃত্যু হয়। কিছুতেই যেন আমাদের বোধোদয় ঘটে না। আমরা একই বিপজ্জনক ধারা অব্যাহত রাখি। নিশ্চয়ই আমরা ভুলে যাইনি গত বছর পুরান ঢাকার উর্দু রোডের একটি ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড ঘটেছিল। ওই ভবনে ছিল প্লাস্টিক কারখানা এবং গুদামঘর। এ ধরনের কারখানা ও গুদামঘর যে অবৈধ, সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। পুরো ভবনটিই পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। সৌভাগ্যক্রমে মানুষের হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। পুরান ঢাকায় প্রতি বছরই একাধিকবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটে থাকে। কিন্তু আত্মঘাতী তৎপরতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি তারা। ফায়ারসার্ভিস কর্তপক্ষ সুপারিশ করেছিল পুরান ঢাকা থেকে সব প্লাস্টিক কারখানা সরিয়ে ফেলার। কিন্তু কে শোনে কার কথা। এবার পুরান ঢাকার আরমানিটোলার ছয়তলা ভবনের নিচতলায় কেমিক্যাল গোডাউনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার ভোরে ওই ৬ তলা ভবনের আগুন চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে কমপক্ষে ২১ জন দগ্ধ হয়েছেন। প্রতি বছরই পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদামের কারণে একাধিক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে। বারবারই হতাহতের ঘটনা ট্র্যাজেডির রূপ নিচ্ছে। এ নিয়ে ক্ষোভ, প্রতিবাদের অন্ত নেই। আমরাও সম্পাদকীয়তে একই সাবধানতার কথা বলে আসছি। কিন্তু কর্তৃপক্ষ কঠোর হচ্ছে না। ব্যবসায়ী ও বাড়িওয়ালাদের বাধ্য করতে পারছে না দাহ্য রাসায়নিক আবাসিক এলাকা থেকে সরিয়ে নিতে। আরমানিটোলার আরমেনিয়ান স্ট্রীটের হাজী মুসা ম্যানশনে আগুনের ঘটনায় চার সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছে ফায়ার সার্ভিস এ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর। আগামী ১০ কার্যদিবসে প্রতিবেদন জমা দেবে এই কমিটি। আমরা আশা করব এবার অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া হবে সুপারিশমালা। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে ভয়াবহ আগুনে মারা যায় ১২৫ জন। ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি চুড়িহাট্টার ওয়াহিদ ম্যানশনে রাসায়নিকের গুদামে বিস্ফোরণে লাগা আগুনে পুড়ে মারা যায় ৭১ জন। ওই বিস্ফোরণের কারণও ছিল রাসায়নিক দ্রব্য। একইভাবে নিমতলীর আগুনের কারণও ছিল রাসায়নিক দ্রব্য, যা জুতার আঠা তৈরির জন্য ব্যবহার করা হয়। নিমতলীর মর্মান্তিক ঘটনার পর রাসায়নিকের গুদাম ও দাহ্য পদার্থ ব্যবহার করে তৈরি পণ্যের কারখানা পুরান ঢাকা থেকে কেরানীগঞ্জে সরিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সেখানে রাসায়নিকপল্লী করার কাজও শুরু হয়। ৯ বছর পর চুড়িহাট্টার ঘটনার পরে গাজীপুরের টঙ্গী ও রাজধানীর শ্যামপুরে অস্থায়ীভাবে রাসায়নিকের ব্যবসা সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ মাঝপথে থমকে যায়। সরেনি রাসায়নিকের গুদাম ও কারখানা। অবৈধ কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসা বাড়িয়েই চলেছেন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবও। যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের জীবনের প্রতি মানুষের দায়বদ্ধতার প্রকাশ ঘটবে, মানুষ দায়িত্বশীল হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত এমন অপমৃত্যুর ঘটনা আমাদের চোখের সামনে ঘটতেই থাকবে। তাই আর নয়, এখনই এর একটা বিহিত হওয়া চাই। মানুষের জীবন নিয়ে আর ছিনিমিনি খেলা নয়। আবাসিক এলাকায় কেমিক্যাল রাখার যেমন নিয়ম নেই তেমনি অনুমতি নেই প্লাস্টিকের মতো দাহ্য পদার্থের কোন কারখানা চালু রাখা। কেমিক্যাল উত্তপ্ত হয়ে আগুন লেগে যেতে পারে এবং একই এলাকায় বহু কেমিক্যাল গোডাউন থাকলে একে একে সবটিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে মহাঅগ্নিকান্ড ঘটার আশঙ্কা থাকে। মালিকদের আর কোন অজুহাত আমরা শুনতে চাই না। রাসায়নিক কারখানা ও প্লাস্টিকের গুদাম অবিলম্বে সরিয়ে নিতে হবে। এ কাজে কর্তৃপক্ষের সক্রিয়তা ও কঠোরতা কাম্য।
Leave a Reply