এক বছরেরও ওপরে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী মানুষের শরীর ও মনোজগতে নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করে চলেছে। চলমান এই মহামারীর ভেতর করোনাযোদ্ধা হিসেবে যারা সবচেয়ে বেশি মানুষের ভালবাসা ও ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছেন তারা হলেন চিকিৎসক তথা স্বাস্থ্যকর্মী। করোনা রোগীদের সুস্থ করে তোলার লড়াইয়ে তারা নিরলস অংশ নিচ্ছেন। অত্যন্ত ছেঁয়াচে রোগ হিসেবে কোভিড-১৯ বিশ্বব্যাপী চোখ রাঙাচ্ছে এবং পারতপক্ষে মানুষ কোন কোভিড রোগীর সংস্পর্শে আসতে চাইছেন না। সেখানে রোগীদের সবচেয়ে কাছে আছেন চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা। পশ্চিমা বিশ্বে অনেক ডাক্তারই ক্লান্তি, অবসাদ ও রোগীকে সুস্থ করে তুলতে না পারার হতাশায় আত্মহননের পথ পর্যন্ত বেছে নিয়েছেন। চোখের সামনে একের পর এক মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে দেখলে সেসব রোগীর সবচেয়ে কাছাকাছি থাকা অক্লান্ত পরিশ্রমী চিকিৎসক, নার্স এবং অন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের মনের অবস্থা কতটা বিষাদময় ও প্রেরণাবিহীন হয়ে ওঠে সেটি আমরা পুরোপুরি হয়ত বুঝে উঠতে পারব না। সারাবিশ্বের মতো আমাদের দেশেও করোনা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে সংক্রমিত হয়ে মারা গেছেন উল্লেখযোগ্য সংখ্যক চিকিৎসক। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে চিকিৎসকসহ সকল স্বাস্থ্যকর্মীর মতো নিবেদিতপ্রাণ করোনাযোদ্ধাদের উৎসাহ দিতে, সাধুবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাতে আমরা কি কিছু করেছি? আমরা বড়ই অসহিষ্ণু। অনেক সময় ভুলেও যাই যে চিকিৎসকরাও রক্তমাংসের মানুষ। তাদেরও প্রয়োজন শ্রান্তিমোচনের অবকাশ, তাদেরও চাই বিনোদন। এত কথা বলার উদ্দেশ্য একটাই, সেটি হলো ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের করিডরে স্বাস্থ্যসেবাদানের পোশাক পরে তিন চিকিৎসকের প্রাণোচ্ছল সংক্ষিপ্ত নৃত্য। ফেসবুকের কল্যাণে জনপ্রিয় লোকগানের সুরে তাদের এই নৃত্য দেখে আনন্দিত ও আপ্লুত হয়েছেন দেশের মানুষ। এই তাৎক্ষণিক আয়োজনের ভেতর দিয়ে জীবনের জয়গানটিই উর্ধে তুলে ধরা হলো। বলাবাহুল্য একটানা সেবাদানের পরে এ ধরনের ছোট্ট আনন্দ প্রকাশের মধ্য দিয়ে নিজেরাও যেমন উজ্জীবিত হওয়া যায়, তেমনি প্রাণের এই স্ফুরণ ছুঁয়ে যায় অবলোকনকারী বা উপভোগকারী সাধারণ মানুষের হৃদয়কেও। দেখবার ও অনুধাবন করবার এই চোখ খুলে দেয়ার জন্য ডাক্তাররা অবশ্যই মানুষের ভালবাসা ও সাধুবাদ পাবেন। বিস্ময়ের সঙ্গে মানুষ আরও একবার প্রমাণ পেলেন আমাদের লোকগানের শক্তি কত গভীর। তিন চিকিৎসক নৃত্য পরিবেশনের জন্য যে গানটি বেছে নেন সেটি বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের লোকগান। হিন্দী ও ইংরেজী গানের এক ধরনের আগ্রাসন রয়েছে সমাজে। সেখানে খাঁটি বাংলা লোকগান নির্বাচনের মানসিকতা প্রশংসাযোগ্য। আইলারে নয়া দামান, আসমানেরও তেরা/বিছানা বিছাইয়া দিলাম শাইল ধানের নেরা/ও দামান বও, দামান বও/বও দামান কওরে কথা, খাওরে বাটার পান,/যাইবার কথা কও যদি কাইট্যা রাখমু কান…। বিয়ের এই গানের সঙ্গে দারুণ নেচেছেন তিন ডাক্তার। বলা চলে, রাতারাতিই তারকাখ্যাতি অর্জন করেছেন ভিডিওর এই কুশীলবরা। জনকণ্ঠের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে প্রাসঙ্গিক কথা। তারকা হওয়া নয়, মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্লান্তি কাটিয়ে নব উদ্যমে কাজে ফেরা। ইন্টার্ন ডাক্তার শাশ্বত চন্দন প্রতিবেদককে বলেন, ‘আমরা সার্জারি বিভাগে লম্বা সময় ধরে ডিউটি করি। কাজ করতে করতে মাঝে মাঝে টায়ার্ড হয়ে যাই। তাই অনেক দিন ধরে ভাবছিলাম, নিজেদের একটু চাঙ্গা করা যায় কিভাবে। সে অনুযায়ী, একটা নাচের ভিডিও তৈরির সিদ্ধান্ত নিই আমরা। আশা ছিল আমাদের পাশাপাশি যে ডাক্তাররা দেখবেন তাদেরও মনোবল বাড়বে।’ তাঁদের অভিপ্রায় প্রশংসনীয় সন্দেহ নেই। একসময় করোনাক্রান্তি হয়ত কেটে যাবে, কিন্তু করোনাকে প্রতিরোধ ও পরাস্ত করার কাজে মানুষের ব্যাপক ও বিচিত্র উদ্যোগের অনেক কিছুই মানুষ স্মরণ রাখবে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে করোনাযোদ্ধাদের মনোবল বাড়ানোর ব্যতিক্রমী এই উদ্যোগটি মানুষের মনের কোণে রয়ে যাবে, এমন প্রত্যাশা অমূলক নয়।
Leave a Reply