পিঠে বোঝা হাতে ঘণ্টি ও লণ্ঠন নিয়ে রানার বা ডাকহরকরার ছুটে চলার কথা আমরা জানি। দূর-দূরান্তে থাকা মানুষের কাছে স্বজনের বার্তা পৌঁছে দেয়ার সেই পুরনো রীতি কি বিপুলভাবেই না বদলে গেছে। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে মোটরগাড়ি, এমনকি উড়োজাহাজের মাধ্যমে দেশের ভেতরে এবং সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে সেই বার্তা পৌঁছানো হয়েছে। অধুনা ডিজিটাল যুগে ইলেক্ট্রনিক মেইল ও সেলুলার ফোনে কাজ অনেক সহজ করে দিয়েছে। এখন দেশে বসেই চোখের পলকে ইউরোপ-আমেরিকায় বার্তা প্রেরণ সম্ভব। আর ভিডিওকলে কাক্সিক্ষত ব্যক্তির মুখ দেখে আলাপ চালানোর প্রযুক্তি এখন প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের কৃষকেরও হাতের মুঠোয়। মানুষ তো শুধু বার্তা প্রেরণ করে না, তার অর্থ বিনিময়ের প্রয়োজন রয়েছে। এককালে ডাক বিভাগ মানিঅর্ডার মারফত একজনের টাকা অন্যজনের কাছে পৌঁছে দিতেও বেশ কয়েকদিন লেগে যেত। এখন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মুহূর্তের মধ্যে টাকা পাঠানো সম্ভব। শুধু টাকা-পয়সাই তো নয়, মানুষ এখন চায় প্রিয়জনের নানা উপহার, এমনকি মৌসুমি ফল পাঠাতে। করোনাকালে অনলাইনে অর্ডার দিয়ে ইচ্ছেমাফিক দরকারি জিনিসপত্র এবং খাদ্য সংগ্রহে গতি এসেছে। রাজধানী অঞ্চলে এখন নতুন ধরনের ‘রানারের’ দেখা পাওয়া যায়। এরা গ্রাহকের পছন্দনীয় রেস্তরাঁর মুখরোচক খাবার পৌঁছে দিয়ে থাকে। মানুষের চাহিদার দিকে নজর দিলে এ কথা আমরা বলতে পারি যে, মানুষের দোরগোড়ায় তার প্রয়োজন অনুযায়ী দ্রব্য বা পণ্য, যেমন- বই, পোশাক, চাল-ডাল, তেল-নুন। এমনকি রান্না করা খাবার পৌঁছানোর সার্বিক কাজটি সম্পন্ন করতে পারে একটি বিশেষ বিভাগ, যার দায়িত্ব নিতে পারে আধুনিক ডাক বিভাগ। ডাক বিভাগের মাধ্যমে এমন বহুমুখী সেবা প্রদানের ধারণা দিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নবনির্মিত হারিয়ে যেতে বসা ডাকবাক্সের আদলে ১৪ তলাবিশিষ্ট দৃষ্টিনন্দন ‘ডাক ভবন’-এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী দারুণ সব যুগোপযোগী আইডিয়া দেন। তিনি বলেন, ডাক ব্যবস্থা শুধু ডিজিটালাইজড করা নয়, আরও সেবা মানুষকে যেন দিতে পারে সে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য আমরা ১১৮টি মেল গাড়ির সংযোজন করেছি। গাড়ি চালানোর জন্য নারী-পুরুষদের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। এখন বিশেষ করে করোনাভাইরাসের পর বেশিরভাগই অনলাইন সেবা কার্যকর, ক্রয়-বিক্রয় চলছে। যেহেতু অনলাইন সেলিং জনপ্রিয়তা লাভ করছে, কাজেই ডাকঘর পিছিয়ে থাকলে চলবে না। ডাক বিভাগকে এই ব্যাপারে আরও দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। ডাক বিভাগের আধুনিকায়ন এবং বহুমুখী সেবা নিশ্চিত করতে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। জেলা ও বিভাগীয় সদরে আধুনিক মেল প্রসেসিং, কুলিং সুবিধাযুক্ত স্টোরেজ, ডিজিটাল সুযোগ-সুবিধা সংবলিত এবং গ্রাহকবান্ধব ৩৮টি মডেল ডাকঘর নির্মাণ কাজে সরকার হাত দিয়েছে। ডাক বাছাই ত্বরান্বিতকরণ ও পচনশীল দ্রব্য সংরক্ষণের জন্য কুলিং চেম্বারের সুবিধা সংবলিত ওয়্যারহাউসযুক্ত ১৪টি অত্যাধুনিক মেল প্রসেসিং ও লজিস্টিক সার্ভিস সেন্টার নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। এটা প্রথমে জেলা ও বিভাগীয় শহরে প্রতিষ্ঠিত হলেও পরে এর লক্ষ্য থাকবে এরকম প্রকল্প উপজেলা থেকে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত অর্থাৎ ডাকঘর যেখানে যেখানে আছে সেখানে এই ব্যবস্থাটার সম্প্রসারণ। দেশবাসীর প্রত্যাশা, বর্তমান ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রবর্তক জনকল্যাণমুখী সরকারের উদ্যোগে ডাক বিভাগের বহুমুখী সেবা নিশ্চিত হবে। তবে এজন্য ডাক বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সব স্তরের কর্মীদের শতভাগ সদিচ্ছা এবং আত্মনিবেদন জরুরী।
Leave a Reply